আগের পর্বে লিখেছিলাম সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটির পাঁচটা ক্যাম্পাসের মধ্যে দক্ষিণ বা South ক্যাম্পাস হল প্রথম এবং প্রধান ক্যাম্পাস। ২০১৮ এর ২২শে মার্চ আমি পৌঁছই এখানে। শেষ পাঁচ বছর এখানে কাটিয়ে একটা জিনিস বুঝেছি – এই ক্যাম্পাসটা খুব পরিকল্পনা করে বানানো। বিগত একশো বছরে অনেক কিছু পাল্টেছে, কোন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ তো কোন দিকে সঙ্কোচন হয়েছে। আর তার সাথে রয়েছে নতুন ও পুরনোর নিয়মিত পরিচর্যা। কিন্তু সব পরিবর্তনই হয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এই ক্যাম্পাসের আসল কাঠামোটাকে ধরে রেখে। আজকের পর্বে থাকলো সেই কাঠামোর ছোট্ট একটা বিবরণঃ
- ইউনিভার্সিটির প্রবেশদ্বারগুলোর সাথে পরিচয়
- প্রধান রাস্তা আর তার চারপাশে ছড়ানো ইতিহাসের টুকরো
প্রায় ১.১৭ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটির এই South ক্যাম্পাসের আকৃতি অনেকটা বাংলা ‘ব’ অক্ষরের মতো। ওপরের দিকে সরু, নীচের দিকটা চওড়া। আর এই ‘ব’কে ঘিরে রয়েছে দুটো প্রধান রাস্তা। ওপরে, মানে উত্তর দিকে বিনজিয়াং ইস্ট রোড (Binjiang East Road), আর দক্ষিণে জিংগাং ওয়েস্ট রোড (Xingang West Road)। এই দুই রাস্তার ব্যস্ত জনাকীর্ণ পৃথিবী থেকে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসকে আলাদা করে রেখেছে অনেকগুলো গেট। আর এই গেটগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ করেছে ইউনিভার্সিটির সবুজ বুক চিড়ে চলে যাওয়া অনেকগুলো ছোটো ছোটো রাস্তা। তাই এই ক্যাম্পাসকে জানতে হলে এই গেট আর রাস্তাগুলোর সাথে পরিচয় হওয়াটা দরকার।
প্রবেশদ্বার
ইউনিভার্সিটির প্রধান গেট হল South গেট, যার বাইরে রয়েছে জিংগাং ওয়েস্ট রোড (Xingang West Road)। গেটের ওপরে সোনালি অক্ষরে লেখা Sun Yat-sen University, Research and Innovation Valley। ইংরেজি নীচেতে, ওপরে চাইনীজে। ৪-৫ জন উর্দিধারি নিরাপত্তাকর্মী সেখানে মোতায়েন। মস্ত বড় লাল রঙের এই গেটের তিনটে ভাগ – দু’দিকে দুটো ছোটো জায়গা লোকজনের পায়ে হেঁটে ঢোকা বেরোনোর জন্য, মাঝের বড় অংশটা গাড়ি চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট। পায়ে হেঁটে ঢোকার সময় ছোটো জায়গাটায় তিনটে গেট পাশাপাশি বসানো। এই গেটগুলো স্বয়ংক্রিয়। প্রতি গেটের ওপরে একটা ক্যামেরা। গেটের সামনে দাঁড়ালে ক্যামেরা প্রথমে চিনে নেয় যে ঢুকতে চাইছে তাকে, তারপর গেট খোলে। ইউনিভার্সিটির লোকজন ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে চাইলে আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়।
গেটের বড় অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে ৫০ মিটারের মধ্যে আরও একটা ছোটো গেট, সেটাকে চেকপয়েন্ট বললে ঠিক বলা হয়। সেখানেও ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়। গাড়ি সেখানে দাঁড়ালে ক্যামেরা ছবি তোলে গাড়ির নাম্বার প্লেটের। একটা ছোটো স্ক্রিনে ফুটে উঠে গাড়ির নাম্বার আর ঢোকার সময়। ১০ সেকেন্ডের এই কাজের পর গেট খোলে।
South গেট ছাড়াও ইউনিভার্সিটির আরও তিনটে বড় প্রবেশদ্বার আছে, যাদের নাম – West গেট, East গেট, এবং North গেট। এদের মধ্যে West গেট আর East গেট মেশে জিংগাং ওয়েস্ট রোডে, মানে ‘ব’ অক্ষরের নীচের দুটো বিন্দুতে। আর North গেট মেশে বিনজিয়াং ইস্ট রোডে (Binjiang East Road), মানে ‘ব’ ত্রিভুজের মাথায়। এছাড়াও আছে তিনটে ছোটো গেট – একটার নাম Little West গেট, দ্বিতীয়টার নাম West North গেট, আর তৃতীয়টা Little North গেট। এই রাস্তাগুলোর সাথে পরিচয় হবে একটু পরেই ইউনিভার্সিটির প্রধান রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে।
রাস্তা
South গেট দিয়ে ঢুকে প্রথম এবং প্রধান রাস্তা নাম ইক্সিয়ান রোড (Yixian Road)। এই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোনোর পরেই ডান দিকে চোখে পড়ে Foreign Language স্কুল। আরও কিছুদূর যাবার পর, একটা রাস্তা বাঁদিকে ঢুকে যায়, এর নাম ইউয়াননান রোড (Yuannan Road)। এই রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলেই আমার অফিস, College of Ecology and Evolution। ইউয়াননান রোড গিয়ে যেখানে আবার জিংগাং ওয়েস্ট রোডের সাথে মিশেছে, সেখানে রয়েছে ইউনিভার্সিটির আর একটা গেট – নাম West গেট।

ইক্সিয়ান রোড, South গেট থেকে সোজা এসে একটা দোতলা বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়ে সেই বাড়িটার দু’পাশ দিয়ে চলে গেছে। এটা সান ইয়াট-সেনের বাড়ি। এই দুটো শাখা – তারা আর মেলেনি একসাথে, চলেছে সমান্তরাল ভাবে প্রায় এক কিলোমিটার। দুটো রাস্তার মাঝে ঘন সবুজের গালিচা বেছান মাঠ। মাঠের মধ্যে কিছু দূর অন্তর সরু সরু পথ, যেগুলো দুটো সমান্তরাল রাস্তার মধ্যে যোগ স্থাপন করেছে। এই মাঠ এবং সান ইয়াট-সেনের বাড়ি ঠিক ইউনিভার্সিটির মাঝখানে অবস্থিত, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, সেন্ট্রাল অ্যাক্সিস। মাঠের ওপর উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ইউনিভার্সিটির ডানদিকের অংশে রয়েছে রেসিডেন্সিয়াল এলাকা, আর বাঁদিকে রয়েছে অফিস এলাকা।
ইক্সিয়ান রোড থেকে কিছু দূর অন্তর অন্তর এক একটা রাস্তা চলে গেছে এই এলাকাগুলোর দিকে। যেমন ইউয়ানবেই রোড (Yuanbei Road) নামে একটা রাস্তা ডান দিকে নিয়ে যায় রেসিডেন্সিয়াল এলাকার দিকে। এই ইউয়ানবেই রোড ইক্সিয়ান রোড থেকে বেরিয়ে যে রাস্তায় এসে মিশেছে তার নাম ইউয়ানডং রোড (Yuandong Road)। ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের থাকার জায়গা এই ইউয়ানডং রোডের দু’দিকে। ইউয়ানডং রোড গিয়ে যেখানে আবার জিংগাং ওয়েস্ট রোডে মিশেছে, সেখানে রয়েছে ইউনিভার্সিটির তিন নম্বর গেট – নাম East গেট।
পুরো জিনিসটা এই ভাবে দেখলে সুবিধে হতে পারেঃ ইক্সিয়ান রোড আর ইউয়ানডং রোড সমান্তরাল দুটো রাস্তা। প্রথমটা শুরু হয়েছে South গেট থেকে, আর দ্বিতীয়টা শুরু হয়েছে East গেট থেকে। দুটো রাস্তা সমান্তরাল ভাবে চললেও মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে ইউয়ানবেই রোডের মতো ছোট রাস্তা।

ইক্সিয়ান রোডের দুটো শাখা প্রায় এক কিলোমিটার পরে আবার মিলেছে একসাথে। যে জায়গায় তাদের মিলন হয়েছে, সেখানে এক বিশাল তোরণদ্বার। ইউনিভার্সিটির এই গেটটার নাম North গেট। এই গেটের বাইরে ফুলের বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তা দিয়ে কয়েক পা হাঁটলেই নদী। ইংরেজি ভাষায় যার নাম পার্ল রিভার, আর স্থানীয় ভাষায় ঝুজিয়াং (Zhujiang)। আর নদীর কোমর ঘিরে যে রাস্তা সাপের মতো চলে গেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, তার নাম বিনজিয়াং ইস্ট রোড (Binjiang East Road)।
আমি ২০১৮ থেকে ২০২১ অবধি থাকতাম ইউনিভার্সিটির ভেতরে, অর্থাৎ ইউয়ানডং রোডের কাছে। আর ২০২১ এর পর থেকে থাকি ইউনিভার্সিটির বাইরে, বিনজিয়াং ইস্ট রোডের কাছে।
