এবার যে কাজের জন্য আসা, সেই বিজ্ঞানী সন্মেলনে যাওয়া, প্যারিস শহর থেকে অনেক দূরে একটা গ্রামে। সেখানে এক বাড়িতে হাউস গেস্ট হয়ে থাকা, শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় আরও একবার শহরে আসা, আর সব শেষে বাড়ি ফেরা – এই সব গল্প থাকছে ‘একদিনের প্যারিস’ এর অষ্টম এবং শেষ পর্বে।
বিজ্ঞানী সন্মেলন
পরের দিন, মানে ১২ তারিখ, আমাকে যেতে হবে সন্মেলনের জায়গায়। জায়গাটার নাম Saint-Remy-les-Chevreuses। RER-B লাইনের শেষ স্টেশন এটা। আমি ট্রেন ধরলাম হোটেলের সব থেকে কাছের ট্রেন স্টেশন, St Michel/Nôtre Dame থেকে। পাঁচ ইউরো দিয়ে টিকিট কেটে চেপে বসলাম ট্রেনে। ১৮টা স্টেশন পেরিয়ে, ৫৩ মিনিট পর এসে নামলাম Saint-Remy-les-Chevreuses স্টেশনে। হোটেল থেকে বেরিয়েছিলাম ব্রেকফাস্ট করে সকাল ৯ টায়। স্টেশনে নেমে সন্মেলনের জায়গাটা ম্যাপ দেখে খুঁজে বের করতে করতে বেজে গেলো সকাল ১১ টা। এর পরের বাকি ৪ টে দিন সেখানে কাটানো – এই নিয়ে বিস্তারিত লিখে পাতা বাড়াবো না। শুধু এ’টুকুই লিখি – এই কটা দিনে আমার এক নতুন কাজের পরিবেশে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের বিজ্ঞানীদের মাঝে একা এশিয়ান হিসেবে নিজের উপস্থিতি নিজেকেই নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছিল অনেকটাই। এতদিনের কূপমণ্ডূক ভাবটা দেশের বাইরে যবে পা রেখেছি, তবে থেকেই কমতে শুরু করেছিল, আর এই ক’দিনে সেটা এক ধাক্কায় আরও অনেকটা কমে গিয়েছিল। দিন থেকে রাত, আবার পরের দিন – কি ভাবে যে সময় কেটেছে, সেটা আজও ভালো করে বুঝিনি। এক দুবার যে মনে হয়নি, যে আর ভালো লাগছে না, তা নয়; কিন্তু সেই ভাবনাটা মনে জাঁকিয়ে বসার সময়টুকুও পায়নি, ফলে মন খারাপগুলোও কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

প্যারিস শহর থেকে অনেক দূরে, এক গ্রামে
সন্মেলনের শেষ দিন মানে ১৫ তারিখ সকাল থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হল। দুপুরবেলা সন্মেলন শেষ হবার পর আয়োজকরা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন স্টেশন অবধি যাবার জন্য। সবার সাথে আমিও স্টেশন অবধি এলাম, কিন্তু বাকি সবার মতো ট্রেন না ধরে স্টেশন এর কাছেই বুক করা হোমস্টেতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। একজন বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী সেটার মালিক, নাম Didier এবং Brigitte। কিন্তু চেক-ইন বিকেল ৫ টার আগে করা যাবে না। তাও একবার অনুরোধ করেছিলাম যখন বুকিংটা কনফার্ম করতে ইমেইল করেছিলাম, ওনারা রাজিও হয়েছিলেন। ভাগ্যিস, না হলে এই বৃষ্টিতে সকাল ১২ টা থেকে বিকেল ৫ টা অবধি কি করতাম, জানি না।
যাই হোক, Brigitte আমাকে অভ্যর্থনা করল ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজিতে। সদর দরজার পরেই একটা প্যাসেজ, দু দিকে ঘর। সেখানে দাঁড়িয়ে আমাকে জুতো খুলতে হল, জুতো পরে বাড়ির ভেতর যাবার নিয়ম নেই। এই জিনিস ইউরোপের কোন বাড়িতে দেখবো, ভাবিনি। জুতো হাতে, লাগেজ আর এক হাতে নিয়ে ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতলা, সেখান থেকে আড়াই তলায় উঠে এলাম। সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, যাকে ইংরাজিতে landing বলে, তার সামনে একটা বাথরুম, দুদিকে দুটো ঘর – আমাকে নিয়ে Brigitte দাঁড়ালো ডান দিকের ঘরটার সামনে। কাঠের দরজার বাইরে একটা নেমপ্লেটে আমার নাম লেখা, চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বুঝলাম এটা বাড়ির চিলেকোঠা।
কিন্তু চিলেকোঠা শুনলেই যে ছবিটা মনে আসে, এটা একদমই সেটার সাথে মেলে না। ঘরের মাঝখানে একটা খাট, দু পাশে টেবিল। দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে একটা বড় ড্রেসিং টেবিল, তার পাশে জামা কাপড় রাখার আলনা। একটা ছোট টেবিলে কাঁচের জারে অনেক টফি রাখা। দরজার উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা জানালা, আর তার নীচে হিটার। ঘরের ছাদটা সোজা নয়, দরজার দিক থেকে ঢালু হয়ে জানালার ওপরে গিয়ে শেষ হয়েছে। আমাকে সব দেখিয়ে দিয়ে Brigitte চলে গেলো, আমিও ভেজা জামা কাপড় ছেড়ে এক কাপ কফি নিয়ে ভাবতে বসলাম – বিকেলে কি করবো। মোবাইল দেখাচ্ছে, বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই, তাপমাত্রাও নামবে। কফি খেতে খেতে মনে পড়ল, এই ঘরে ধূমপান করা যাবে না। নীচে গেলাম, সেই জুতো হাতে নিয়ে, সদর দরজা দিয়ে বাইরে বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালাম, এটা ধূমপানের জায়গা বোঝাই যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক করে ফেললাম কি করবো। বাইরে তখন বৃষ্টির জল সাদা হতে শুরু করেছে।

শেষ অ্যাডভেঞ্চার
ঘরে ফিরে জামা কাপড় পাল্টে, পিঠের ব্যাগে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। দুপুরের খাওয়া সেরেই এসেছিলাম সন্মেলনের জায়গা থেকে, রাতেরটা পরে ভাবব। Brigitte কে বললাম, “শহরে যাচ্ছি, ফিরতে একটু রাত হতে পারে।”
সে বলল, “তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করো, বৃষ্টি বাড়বে, বরফ পরতে পারে, ট্রেন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
ঘড়িতে দেখলাম বিকেল ৩টে, সব ঠিকঠাক হলে ৭ টার মধ্যে ফিরে আসা উচিৎ। স্টেশনে এসে ৫ ইউরো দিয়ে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালাম। চারদিন আগে যখন এসেছিলাম, তখন ভালো করে দেখা হয়নি স্টেশনটা, এবার দেখলাম দুটো প্ল্যাটফর্ম। যেহেতু এটা এই লাইনের শেষ স্টেশন, যে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসে, সেখান থেকেই আবার উল্টো মুখে ফেরত যায়। যদি না ফিরতে চায়, তাদের জন্য পাশের প্ল্যাটফর্মটা। সেখানে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। রঙ্গিন ডিসপ্লে বোর্ডটা ভালো করে দেখে বুঝলাম, এখনও ট্রেন আসতে ৮ মিনিট মত বাকি। আর কোন লোক না দেখে প্রথমটায় একটু অবাক হয়েছিলাম, পরে বুঝলাম বৃষ্টির জন্য সবাই টিকিট ঘরের সামনে ছাউনির তলায়। আঠেরোটা স্টেশন পেরোতে হবে, যার মধ্যে ৬ টা স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াবে না। ট্রেন এল ঠিক সময়ে, আমিও ফাঁকা একটা কোচ দেখে উঠে বাঁ দিকে জানালার ধারে বসলাম – এই দিকেই প্ল্যাটফর্মগুলো পড়বে। নামগুলো দেখা দরকার, না হলে নামতে পারবো না ঠিক জায়গায়।

ট্রেন ছাড়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে বাইরে দিনের আলো নিভে এলো। কিন্তু তার আগেই আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি – যে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো হোটেল থেকে বেরোনোর সময় সাদা মনে হয়েছিল, সেগুলো এখন হাল্কা বরফের কুচি হয়ে হাওয়ার সাথে মিশে উড়ে বেড়াতে শুরু করেছে। নীচের কালো প্ল্যাটফর্ম রঙ পাল্টাচ্ছে। এই ভাবে চলল ঘণ্টা দেড়েক, যত ট্রেন এগুচ্ছে, ভিড় বাড়ছে। Luxembourg স্টেশন আসতে উঠে দাঁড়ালাম, নামতে হবে পরেরটায়। কিন্তু নামবো বললেই কি নামা যায়? ভিড় এত বেড়েছে যে পা ফেলে সামনে এগুনোর কোন জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে একজন লোক কে ধাক্কা মেরে, একজনের হাতের তলা দিয়ে, একজনের পা মাড়িয়ে অবশেষে প্লাটফর্মে নামতে পারলাম – সেই স্টেশন যেখান থেকে আমি চার দিন আগে উল্টো দিকের ট্রেন ধরেছিলাম, St Michel/Nôtre Dame। এখনকার গন্তব্য Annick Goutal পারফিউমের দোকান।

প্যারিসের ভালো পারফিউম বলতে স্থানীয় লোকেরা যে কটা জায়গার নাম বলে, এটা তাদের মধ্যে একটা। অন্যগুলো অনেক দূরে, আর এখানে যাবার রাস্তার কিছুটা আমার পরিচিত, তাই এই দোকানেই যাব ঠিক করে রেখেছিলাম। ট্রেনে বসেই ম্যাপটা ভালো করে দেখে নিয়েছিলাম, এখন দেখলাম ঘড়িতে বিকেল ৫টা। স্টেশন থেকে ওপরে এসে যে রাস্তা দিয়ে ল্যুভরে গিয়েছিলাম, সেই একই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। ভেজা পাথুরে রাস্তায় ভয় হয় পা না হড়কে যায়, তার ওপর উল্টোদিক থেকে আসা অফিস ফেরত গাড়িগুলোর আলো ভেজা রাস্তায় ধাক্কা খেয়ে চোখে এসে পড়ছে, তাই গতিও বাড়াতে পারছি না। এর মধ্যে ছাতাটাও অবাধ্য হয়ে উঠছে মাঝে মাঝে, আর তার কানে এসে কুবুদ্ধি দিচ্ছে নদীর পারের লাগাম ছাড়া হাওয়ার দল। তারা আবার হাত মিলিয়েছে বৃষ্টির জোলো হাওয়ার সাথে, সব মিলিয়ে শরীরের ভেতর আসতে আসতে বাড়তে থাকা কাঁপুনিটাও জানান দিচ্ছে।
বৃষ্টি ভেজা ল্যুভরকে ডান পাশে রেখে এসে পড়লাম Rue de Rivoli তে, সেখান থেকে বাঁদিকে মিনিট ২০ হেঁটে, রাস্তা পেরিয়ে ডানদিকের একটা ছোট রাস্তায় ঢুকলাম – এটার নাম Rue de Castiglione। এই রাস্তা দিয়ে একটু এগুতেই ডান দিকে চোখে পড়ল দোকানটা। ভেতরে ঢুকে যা দেখলাম আর শুঁকলাম, কোনোদিন ভুলবো কিনা বা ভুলতে পারবো কিনা, জানি না। তিন মানুষ লম্বা একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাঁচের শোকেসে থরে থরে সাজানো কাঁচের বোতলে বিভিন্ন রঙের পারফিউম, তাদের প্রত্যেকের গন্ধ আলাদা। ফেরার সময় ট্রেনে বসে গুনেছিলাম – আমি শুঁকেছিলাম প্রায় ১৮ রকমের গন্ধ, ৫ টার পর থেকে গন্ধ বিচারের ক্ষমতা কমতে কমতে ৯টার পর থেকে লোপ পেয়েছিল। সে যাই হোক, এরই মধ্যে দু’টো পছন্দ করে নিলাম – তাদের অনেক রকম নাম, অনেক রকম ভাগ – সেই সব আর লিখে কাজ নেই। দু’জন মেয়ে দোকানের দেখাশোনা করে, তাদেরকে গিফট এর কথা বলতেই তারা খুব সুন্দর করে প্যাক করে দিল। সেটা পিঠের ব্যাগে চালান করে দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম – আসার উদ্দ্যেশ্য সফল। ফেরার পথে মায়েদের আর বাবাদের জন্য কিছু জিনিস, আমার বসের জন্য একটা শো-পিস কিনে ফেরার ট্রেনে উঠলাম। ঘড়িতে তখন সন্ধে সাড়ে ৭টা।

হোমস্টেতে ফিরে সদর দরজা ঠেলে ভেতরে যখন ঢুকছি, তখন রাত ৯টা। দরজার মাথায় একটা ঘণ্টিতে টান পরতেই সেটা মিষ্টি একটা আওয়াজ করে আমাকে স্বাগত জানালো। ফেরার সময় খাবার পাইনি কিছু, যাবার সময় যে দোকানগুলো দেখেছিলাম স্টেশনের পাশে, সেগুলো সব বন্ধ – দেখে এসেছি। ম্যাপে দেখাচ্ছে আশেপাশে দেড় কিলো মিটারের মধ্যে আর কিছু নেই। বুঝলাম উপোষ করা ছাড়া গতি নেই। শেষ আশা ছিল যদি হোমস্টেতে কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু রাত হয়ে গেছে অনেক, তাদেরকেও বিরক্ত করতে মন চাইল না। ঘরে ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে, কফি বানালাম। পরে থাকা তিনটে macron আর কাঁচের জারে রাখা টফি দিয়ে ডিনার সেরে সোজা বিছানায়। মোবাইলে ওয়েদার রিপোর্ট বলছে – বাইরে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি আর তার সাথে বৃষ্টি আর বরফ।

ফিরে যাবার সময় উপস্থিত
পরের দিন, মানে ১৬ই নভেম্বর, আমার ফেরার পালা। উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি সেই দিনে, শুধু অদ্ভুত ভাবে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। এটা আলাদা তার কারণ আগে এত বার এত জায়গায় গেছি, সেখান থেকে ফেরার সময় অনুভুতিটা হতো আলাদা। হোমস্টে থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে এয়ারপোর্টে যেতে যেতে এই বৈপরিত্যটাই খোঁচা দিচ্ছিল বার বার। একবার মনে হল, বয়স হয়ে যাচ্ছে, নিজের চেনা পরিবেশ থেকে তাই বাইরে বেরোলেই মনটা ফেরত যাই – ফেরত যাই করে। আরও কয়েক বছর আগের নতুন কিছু করার, চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোনোর ইচ্ছেটা আজ ডুব মেরেছে কোথাও। তারপর মনে হল – এই জায়গাটা হয়তো আমার ভালো লাগে নি। লোককে বললে হাসবে – প্যারিস ভালো লাগে নি? ভেবে দেখলাম, এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই জোরালো হল। এর কারণটাও খুঁজে পেলাম – বড্ড একা লেগেছে এই কদিন। যে কটা জায়গায় ঘুরেছি এই শহরে, সব সময়ই মনে হয়েছে ‘চি’ টা সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। ভালোবাসার শহর বলে খ্যাতি আছে শুনেছি প্যারিসের, তারই প্রভাব হয়তো। ভেবেছিলাম কাজের জায়গায় গেলে মনটা ঠিক হবে – যেরকম আগেও হয়েছে যখনই কোন সন্মেলনে গেছি। এখানে দেখলাম সেটা হল না, এখানের লোকজন খুব প্রফেশনাল, কাজের বাইরে অন্তরঙ্গতার কোন সুযোগ ঘটেনি, তাই একাকীত্বটাও জাঁকিয়ে বসেছিল। এরকম নয় যে এখান থেকে যেখানে ফিরছি, সেখানেও প্রচুর সঙ্গ পাবো। কিন্তু তাও সেটা আমার কর্মস্থল, গত দেড় বছরে যে শহরের সাথে আমার ভালোলাগাটা বেড়ে উঠেছে একটু একটু করে, অনেক কারণে।
যে পথ দিয়ে ছ’দিন আগে এসেছিলাম, সেই একই পথ দিয়ে এবার ঘরে ফেরা। এয়ারপোর্টে পৌঁছে সব ফর্মালিটি শেষ করে আগে পেট ভরে খেলাম – বার্গার, কেক, কফি। সামনে এক বৃদ্ধ দম্পতি, এশিয়ার কোন দেশের, দেখে মনে হয় ট্যুরিস্ট। তাদের অল্পবয়সী সঙ্গীরা দূরে বসে, কিন্তু এনারা দুজন নিজের মতো করে ব্যস্ত। বসার লাউঞ্জের একদম সামনে কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে একে অপরের ছবি তুলে দিতে ব্যস্ত, পেছনে অপেক্ষমান প্লেন। দেখে মনে হয়, তাদের খুব বেশী সুযোগ হয়নি আজ পর্যন্ত আকাশে ওড়ার, নীচের ওই পৃথিবীর রোজকার লড়াইতেই চলে গেছে অনেক গুলো বছর। আজ সুযোগ এসেছে, কে জানে, হয়তো প্রথমবার বিদেশ যাত্রার। তাহলে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কোন এক রাতে একসাথে দেখা একটা স্বপ্নকে সত্যি করার ওই সরল বিস্ময়, ওই হাসি – এর থেকে ভালো পুরস্কার আর কিই বা হতে পারে? ভাবতে ভালো লাগে, যদি সত্যি এমনটা হয়। প্যারিসে এটাই আমার সবথেকে প্রিয় স্মৃতি, সব থেকে ভালো ফ্রেম।

দুপুর ১২ টা ২৫ এ এয়ার চায়নার প্লেন, বেজিং হয়ে যখন গুয়াংজু নামলাম, তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে ১১ টা, তারিখটা ১৭ ই নভেম্বর। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাসে করে ইউনিভার্সিটি পৌঁছলাম দুপুর দেড়টা। বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে ল্যাপটপে ছবিগুলো কপি করার সময় চোখে পড়ল যাবার আগে আমার করা নোট্সগুলোর ওপর। অনেক কিছু দেখা হল না এবারে, পরের বার সব দেখবো হাতে সময় নিয়ে। তবে আর একা নয়, এবারের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো জুড়ব পরের বার আরও ভালো করে, দুজনের হাত দিয়ে। ততদিন এগুলোই থাকুক জমানো, সময় অসময়ে পাতা উলটে পড়ে না হয় ঘুরে আসা যাবে আরও কয়েকবার।