“যদি হাতে সময় কম থাকে পুরো প্যারিস দেখার, তাহলে এই বাগানে এই জলাশয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাও” – আসার আগে এই লাইনটা কোথাও একটা পড়েছিলাম। ‘একদিনের প্যারিস’ এর চতুর্থ পর্বে থাকছে আরও দুটো দ্রষ্টব্য স্থান – Pantheon এবং Tuileries Garden।
দ্রষ্টব্য চার – Pantheon
ত্রিভুজের মাথায় ফিরে এসে একটু বাঁদিকে বেঁকে এবার চললাম যে রাস্তাটা ধরে, তার নাম Rue Soufflot। দশ মিনিট চলার পরে, এই রাস্তার একবারে শেষে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে Pantheon, যার বাংলা মানে হয় ‘সব ভগবান’। প্যারিসের আকর্ষণীয় ও দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন, তৈরি হয়েছিল ১৭৬৪ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে। প্রথমে এটা একটা চার্চ হিসেবে তৈরি হলেও, ইতিহাসের উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে অনেক বার পরিবর্তিত হয়েছে এর পরিচিতি। আজ এই স্থাপত্য বহন করছে এক উপাসনালয়ের মর্যাদা আর এর নিচে চির নিদ্রায় শায়িত ফ্রান্সের বীর শহিদ আর বিখ্যাত মানুষজন।
Pantheon এর গেটে সোনালি অক্ষরে সেই কথাটারই প্রতিধ্বনি – “Aux Grands Hommes La Patrie Reconnaissante”, যার ইংরেজি মানে – “To Great Men, The Grateful Homeland”।
শুনেছিলাম এর ওপর থেকে নাকি পুরো প্যারিস শহর দেখা যায়, কিন্তু ভাগ্য এবার সঙ্গ দিল না। সকাল ১১ টার আগে Pantheon খুলবে না। কি আর করি, চারপাশে ঘুরে বেড়ালাম একটু, বৃষ্টিতে ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে। Pantheon এর বিশাল গম্বুজওলা বাড়িটার সামনে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁদিকে টাউন হল আর ডানদিকে কোর্ট হাউস, Pantheon এর আকার আর ঐতিহ্যের এর সাথে পাল্লা দিতে তারা কোন অংশে কম নয়।

হাঁটতে হাঁটতে পেছন দিকে গেলাম, কোথায় যেন পরেছিলাম – ইতিহাস কখনও জীবন্ত হয়, এই জায়গায় এসে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। পাথরের রাস্তা, ঘরবাড়ি, আজও একইরকম ভাবে রয়েছে, ব্যবহৃত হয়, গাড়ি চলে, লোকে বসবাস করে। অতীত যেন এখানে বর্তমানের সাথে হাত ধরাধরি করে চলে। ভেতরে ঢুকতে না পারার মন খারাপটা কেটে গিয়ে কখন যেন অবাক বিস্ময়ে ভরে গেছে মন, বুঝতেই পারিনি। বৃষ্টিটা থেমেছিল কিছুক্ষণের জন্য, আবার শুরু হল টিপ টিপ করে। ইতিহাসকে পেছনে রেখে ফিরতেই হল আমাকে। পরের গন্তব্য অনেক দূরে, হেঁটে যেতে সময় লাগবে। নতুন কেনা জ্যাকেটটা ওয়াটার রেসিটাণ্ট, সেটাকে মাথার ওপর তুলে দিয়ে হাঁটা লাগালাম।

যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, সেই রাস্তা ধরেই এবার চললাম হোটেলের দিকে। ঘড়িতে দেখলাম একটু সময় আছে পরের গন্ত্যব্যে যাবার আগে। তার ওপর আমি পুরো ভিজে গেছি, ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত করছে খুব। ছাতাটা হোটেলের রুমে আছে – সেটাও নিতে হবে। এই সব কারণে একবার হোটেলে ঢুঁ মারব ঠিক করলাম। এই সময় বৃষ্টিটা আরও জোরে এল, ক্যামেরা আর নিজেকে বাঁচানোর জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। এটা একটা খোলা জায়গা, তিন দিকে বাড়ি দিয়ে ঘেরা, আর রাস্তায় অনেক ছাতাওলা টেবিল পাতা। সেই রকমই একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম কিছুক্ষণ। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম এটা University Paris-Sorbonne এর ক্যাফেটেরিয়া। বৃষ্টিটা একটু ধরলে দৌড়লাম হোটেলের দিকে। ১৫ মিনিট পর যখন হোটেলে পৌঁছলাম, তখন ঠাণ্ডায় বৃষ্টিতে ভিজে সারা শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছে। এক কাপ কফি খেয়ে আবার বেরলাম। ঘড়িতে তখন সকাল ন’টা পঁয়তাল্লিশ।
নদীর পারে এসে ব্রিজ পেরিয়ে সকালে যে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছিলাম, সেই রাস্তাটা আবার ধরলাম। এই রাস্তাটা নদীর পার দিয়ে দিয়ে চলেছে, যেতে যেতে সকালে যে অবধি এসেছিলাম, সেই জায়গাটাও পেরিয়ে গেলাম। ম্যাপে দেখাচ্ছে এই রাস্তার নাম Quai de la Megisserie, এটা আমি জানি কারণ সকালে এখানে আমি এসেছি, Pont Neuf ব্রিজ অবধি। এই ব্রিজটা ছাড়িয়ে আরও মিনিট ২০ হাঁটার পর, রাস্তাটার নাম বদলে হল Quai Francois Mitterrand। বাঁদিকে নদী যেমন ছিল, তেমনই আছে, কিন্তু ডানদিকে এতক্ষণ ধরে থাকা ব্যস্ত শহর আর দেখা যাচ্ছে না, বদলে পুরনো দিনের উঁচু উঁচু বাড়ি, তাদের চারপাশে অনেকটা করে খোলা জায়গা। আরও একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে, ম্যাপে যার নাম Pont Des Arts। আরও একটু এগুতেই রাস্তার দুটো শাখা বেরিয়েছে – একটা বাঁদিকে ব্রিজ হয়ে নদী পেরিয়েছে, যার নাম Pont du Carrousel, আর ডানদিকের শাখাটা একটা প্রকাণ্ড গেটের নীচে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। সিগন্যাল পেরিয়ে ওই ডানদিকের রাস্তাটা ধরে গেটের নীচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি একটা খোলা জায়গায় এসে পড়েছি। রাস্তাটা এই খোলা জায়গাটাকে দু ভাগে ভেঙ্গে সোজা উল্টো দিকের আর একটা গেটের নীচ দিয়ে বাইরে চলে গেছে। রাস্তার বাঁদিকে দূরে গাছের সারি, সাজানো বাগানের মতো দেখতে লাগছে এখান থেকে। আমি জানি ওটা Tuileries Garden। আর ডানদিকে সেই বিখ্যাত ল্যুভর। ম্যাপে দেখাচ্ছে হোটেল হেঁটে এসেছি প্রায় ২ কিলোমিটার। ঘড়িতে বেজেছে সাড়ে ১০ টা, তার মানে আরও দেড় ঘণ্টার আগে ল্যুভরের দিকে গিয়ে লাভ নেই, তাই বাঁদিকের বাগানের দিকেই চললাম।
দ্রষ্টব্য পাঁচ – Tuileries Garden
রাস্তা পেরিয়ে, একটা গেটের তলা দিয়ে যখন বাগানে ঢুকলাম, তখন বুঝতে পারলাম কেন এটাকে প্যারিসের সব থেকে বড় বাগান বলে চিহ্নিত করা হয়। বালি আর কাঁকর মেশানো একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে বাগানের মাঝ বরাবর। রাস্তার দু পাশে বিখ্যাত স্থপতিদের হাতে তৈরি মূর্তির সারি, ডান দিকে প্রকাণ্ড এক নাগরদোলা যেটা গরমের সময় এখানে যে মেলা হয় তার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। রাস্তাটা একটা জলাশয়কে গোল করে পাক খেয়ে আবার সোজা হয়ে চলতে শুরু করেছে। এই জলাশয়ের চারপাশে সবুজ রঙের অনেক চেয়ার পাতা, যার সব কটাই এই বৃষ্টিতে খালি। আরও কিছু দূর হেঁটে গেলে রাস্তার দুপাশে সঙ্গী হয় গাছের সারি। ভাবতে ভালো লাগছিল যখন বসন্তে এদের গায়ে রঙ লাগবে, তখন না জানি এদের আরও কত সুন্দর লাগবে। রাস্তাটা শেষ হয়েছে আরও একটা জলাশয়ে এসে। আসার আগে পরেছিলাম, যদি হাতে সময় কম থাকে পুরো প্যারিস দেখার, তাহলে এই বাগানে এই জলাশয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাও। সামনে Place de la Concorde র মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো স্মারক স্তম্ভ, পেছনে ল্যুভর, বাঁ দিকে সেইন নদীর ওপারে Orsay Museum আর ডান দিকে Tuileries Palace। আশ্চর্য নয় যে UNESCO এই জায়গাটাকে World Heritage Site এর তকমা দিয়েছে। ছবি তুলে আর মূর্তির তলায় লেখা গুলো পড়তে পড়তে কাটিয়ে দিলাম ঘণ্টা খানেক, এবার পেছনে যাবার পালা।
