আজ প্যারিসে আমার প্রথম সকাল। ব্রেকফাস্টের পর দেখে নিলাম দুটো জায়গা – সেইন নদী আর Luxembourg Gardens। ‘একদিনের প্যারিস’ এর তৃতীয় পর্বে থাকছে হেঁটে শহর দেখার শুরুর কথাগুলো।
প্যারিসে প্রথম সকাল – ব্রেকফাস্ট দিয়ে শুরু
ঘুম ভাঙল বেশ সকালে, ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৬ টা। উঠে কফি খেয়ে তৈরি হয়ে নিচে নামলাম। ব্রেকফাস্টের রুম টা খুঁজে নিয়ে ঢুকে পরলাম। ভেতরে দেখি প্রচুর খাবার সাজানো – বুফে সিস্টেম। প্রায় ১০-১২ রকমের ব্রেড, ফলের জুস, কাটা ফল, মাংস, ডিম, চা, কফি – সে এক এলাহি ব্যাপার। যাই হোক, আমি কয়েক রকমের ব্রেড আর গোটা দুই ডিম সেদ্ধ নিয়ে এসে বসলাম। এত সকালে অত বড় ডাইনিং হলে আমি একা। খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম একজন মেয়ে ভেতরে রান্না ঘরে কাজ করছে, কিছুক্ষণ পরে পরে এসে ডাইনিং হলের সাজানো খাবারের তদারকি করে যাচ্ছে।
আমি জিজ্ঞ্যাসা করলাম – ‘কফি পাওয়া যাবে?’। যদিও কফি তৈরির মেশিন একটা দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু সেটা কি করে চালাতে হয়, আমি জানি না।
মেয়েটা এশিয়ান, খুব অল্প বয়স, দেখে মনে হয় কলেজে পড়ে। হেসে বলল, ‘আপনি কি চীন থেকে আসছেন?’
আমি অবাক হয়েছি দেখে আরও একটু ভেঙ্গে বলল ‘আমাদের ম্যানেজার বললেন একজন গেস্ট এসেছেন চায়না থেকে, তাই আপনাকে জিজ্ঞ্যাসা করলাম’।
আমি যদিও অবাক, তবুও বললাম ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি ভারতীয়। কর্মসূত্রে চীনে থাকি, তাই ওখান থেকেই আসছি’।
মেয়েটার ইংরেজি ভাঙ্গা ভাঙ্গা, তাই প্রশ্ন করলাম, ‘তুমিও কি চীন দেশ থেকে?’।
সে বলল, ‘না, আমি থাইল্যান্ডের’।
‘এখানে কি করছ?’ আমার আন্দাজটা খুব ভুল না জেনে সাহস করে জানতে চাইলাম।
মেয়েটি বলল, ‘আমি এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, আর সকালে এখানে কাজ করি, হাতখরচ ছাড়াও ইউনিভার্সিটির ফি কিছুটা দিতে পারি, বাকিটা বাবা পাঠায় দেশ থেকে’।
‘কি নিয়ে পড়াশুনো করছ?’
প্রশ্নের উত্তরে জানলাম এশিয়ান স্টাডি নিয়ে মেয়েটা আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্রী। সেও জানতে চাইল, আমি কি নিয়ে কাজ করি, এখানে কেন এসেছি, কতদিন থাকব, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার কৌতুহল নিবৃত্তি করে কফি আনতে বললাম। সে আমাকে ভেতর থেকে কফি পটে করে গরম কফি, কাপ, চিনি নিয়ে এলো। তার সাথে গল্প করতে করতে গরম দু’কাপ কফি খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ৮ টা বেজে গেছে। মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, অনেক জায়গার যাবার আছে আজকে। আর দেরি করা চলবে না।
দ্রষ্টব্য দুই – সেইন নদী
হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে কাল যে রাস্তা দিয়ে রাতে হেঁটেছিলাম, সেই রাস্তা ধরে চললাম। নদীর পারে এসে আজকে আর নদী না পেরিয়ে, ডানদিকের রাস্তাটা ধরে এগুলাম। রাস্তা ফাঁকা, দোকানগুলোও সব বন্ধ এখনও। কিছুদুর গিয়ে রাস্তাটা ডানদিকে বেঁকেছে, আমিও ঢুকলাম, এই রাস্তাটার নাম Rue du Petit Pont। এই রাস্তাটা ধরে ৪-৫ মিনিট হাঁটার পরেই চোখে পড়ল Saint-Julien-le-Pauvre চার্চ। এত সকালে বন্ধ চার্চের সামনে দাঁড়িয়েও অনুভব করা যায় গথিক শিল্প কীর্তির এই নমুনার বিশালত্ব, চোখে পড়ে সময়ের হাতের ছাপ এর সর্বাঙ্গে। প্যারিস এর অন্যতম সুন্দর এই চার্চ বাইরে থেকে দেখে কিছু ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম।

যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, ফিরে চললাম সেই রাস্তা ধরে, এসে পৌঁছলাম নদীর ধারে। নদী পেরিয়ে ব্রিজ টা যে রাস্তার সাথে মিশে গেছে তার নাম Bd du Palais। এই রাস্তা ধরে ৫ মিনিট মতো হাঁটতেই বাঁদিকে পড়লো Sainte-Chapelle আর ঠিক তার পাশেই Conciergerie। প্রথমেরটা চার্চ যেটা এখনও বন্ধ, বাইরে লোকের ভিড় জমছে একটু একটু করে। প্যারিস শহরে এরকম চার্চ প্রচুর ছড়িয়ে আছে আর তার সব কটাই কোন প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। পরেরটা একটা অট্টালিকা, যা আগে ব্যবহার হত জেলখানা হিসেবে, আর এখন কোর্ট হিসেবে।
এর পর পড়লো আরও একটা ব্রিজ, নাম Pont au Change। সেটা পেরিয়ে রাস্তাটা অনেক দিকে চলে গেছে, আমি বাঁদিকের রাস্তাটা যেটা নদীর পাশ দিয়ে চলেছে সেটা ধরে এগুলাম। এই রাস্তার নাম Quai de la Megisserie, রাস্তার বাঁদিকে নদী আর ডান দিকে দোকানের সারি, স্থানীয় ভাষায় যাদের বলা হয় Brasserie, দোকানের সামনে চাঁদোয়া খাটিয়ে বসার জায়গা। কিছু খোলা যেগুলোতে ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায়, দোকানের বাইরে হরেক রকমের রঙ্গিন পোস্টারে মেনু লেখা। অল্প কিছু মানুষ জনও চোখে পড়লো, যাদের বেশিরভাগ প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছেন। কেউ হাঁটছেন, কেউ বা জগিং করছেন। গাড়ি খুব অল্প, দু একটা বাস অল্প যাত্রী নিয়ে চলেছে। তবে ভিড় জমেছে জলে, স্বচ্ছ সেইন নদীতে যারা ডানা ঝাপটে শান্ত সেইন নদীকে করে তুলছে অশান্ত। জলের সেই অস্থিরতা সংক্রামিত হয়েছে আকাশেও। ছোট একটা কালো মেঘ সকালে উঠেই চোখে পড়েছিল আকাশের পশ্চিমে, সেটা এখন বড় হয়ে পুরো আকাশটাকেই ঢেকে ফেলেছে প্রায়। বুঝলুম দুর্যোগ আছে কপালে।

দশ মিনিট মতো হাঁটার পর আবার একটা ব্রিজ। ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম সেইন নদীর দুই পাড় কে যোগ করেছে এরকম প্রচুর ব্রিজ। এই ব্রিজটার নাম Pont Neuf। ব্রিজে উঠলাম, নদী এখানে খুব চওড়া নয়। ব্রিজের দু পাশে বাতিস্তম্ভের সারি, আর তার প্রত্যেকটাতে অদ্ভুত সুন্দর শিল্পকর্মের নিদর্শন। ব্রিজের অপর প্রান্তে ডানদিকে ঘোড়সওয়ার নেপোলিওনের মূর্তি, আর তার পাশ দিয়ে নিচে নেমে গেছে জেটিতে নামবার সিঁড়ি। এই জেটি থেকেই শুরু হয় সেইন নদীতে নৌকো বিহার। রাস্তার অপর দিকে দিক নির্দেশক চিহ্ন, যার মধ্যে বেশ কয়েকটা আজ আমাকে যেতে হবে। নদী পেরুলাম, তারপর বাঁদিকের রাস্তা ধরলাম, আন্দাজে বুঝতে পারছি এই রাস্তাটা ধরে গেলে পৌঁছনো যাবে সেই চৌমাথায় যেখানে আজ সকালে আমি প্রথম নদী পেরিয়েছিলাম। হোটেল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি। এবার হোটেলে যাওয়া দরকার, ছাতা নিতে হবে, বৃষ্টি আসছে খুব শীগগিরই।

দ্রষ্টব্য তিন – Luxembourg Gardens
Pont Neuf থেকে হোটেলে ফিরতে সময় লাগলো প্রায় ১৫ মিনিট মতো। হোটেলে থেকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এবার চললাম বাঁদিকে – নদী যেদিকে তার উল্টো দিকে। গন্তব্য Jardin du Luxembourg বা Luxembourg Gardens। ম্যাপ বলছে হোটেল থেকে হাঁটতে হবে ১৫ মিনিট মতো, প্রায় ১ কিলোমিটার। ম্যাপ দেখে চলছি, বুঝতে পারছি সামনে একটা চৌমাথা থেকে ডানদিকে যেতে হবে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই এলো মোড়টা, আর একটা বড় রাস্তা এসে এই রাস্তাটাকে কেটেছে এই জায়গায় যার ফলে একটা সমবাহু ত্রিভুজের মতো তৈরি হয়েছে যার দুটো পাশাপাশি বাহু এই দুই রাস্তা। এই ত্রিভুজের মাথায় চোখে পড়ল একটা ম্যাক ডোনাল্ড আর একটা বার্গার কিং এর দোকান। সমবাহু ত্রিভুজের যে রাস্তা টা ধরে আমি আসছিলাম, এবার অন্য বাহুটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম, ম্যাপে দেখলাম এটার নাম Rue de Medicis। Rue শব্দের মানে যে রাস্তা বা Street সেটা জানা ছিল আগেই। ডানদিকে বেঁকে একটু যেতেই একটা গেট, খোলা ছিল, ঢুকে পরলাম।
ভেতরে ঢুকে দেখি একটা বাগান, যার দু পাশে গাছের সারির মধ্যে দিয়ে কাঁকর বেছান রাস্তা। মনে হল ঠিক জায়গাতেই এসেছি, কিন্তু আসার আগে যে ছবি দেখেছিলাম, তার সাথে তো মিলছে না। ঠিক করলাম এগিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে। মেঘ ডাকতে শুরু করেছে, আমি এগুলাম। বাগানের মধ্যে বসার বেঞ্চ, সব খালি, কোনও মানুষের চিহ্ন নেই কোনোদিকে। আরও কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়লো উঁচু বেদীর ওপর দাঁড়ানো এক পুরুষ মূর্তি, আমি যেদিক থেকে আসছিলাম সেদিকে পেছন করে। সেই মূর্তিকে পাশ কাটিয়ে সামনেই দেখি ছবিতে দেখা সেই বিশাল অট্টালিকা, বুঝলুম এসে পরেছি Jardin du Luxembourg বা Luxembourg Gardens এ।

আসার আগে পড়েছিলাম ১৬১২ সালে Queen Marie de Medici তৈরি করান এই বাগান। ২৫ হেক্টর জমির ওপর ছড়িয়ে থাকা এই বাগান আজ প্যারিসের অন্যতম প্রধান এক আকর্ষণ আর ওই সুবিশাল অট্টালিকা আজ সরকারি কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। অট্টালিকার সামনে এক সুদৃশ্য সরোবর, আর তাকে দু পাশ দিয়ে জড়িয়ে কাঁকর বেছান রাস্তা। রাস্তার দু পাশে জমি উঠে গেছে উপরের দিকে, সেই উঁচু জায়গায় একদিকে সারি সারি মূর্তি, অন্যদিকে যতদূর চোখ যায়, সবুজের সমারোহ। সরোবরের মাঝখানে এক নারী মূর্তি, তার হাতে জলের কলসি। আর তাকে ঘিরে সেই সাদা জল পাখীদের সমারোহ। ওই যে সারি দিয়ে দাঁড়ানো সব মূর্তি, তাদের সংখ্যা ১০০ ওরও বেশী, সব মূর্তি অভিজাত আর বিখ্যাত ইউরোপিয়ান আর ফ্রেঞ্চ মহিলাদের – ১৯ শতক থেকে আজ অবধি ক্রমান্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এই সব শিল্পের নিদর্শন।
একটা মূর্তির তলায় ফরাসী ভাষায় লেখা দুটো লাইন, যার ইংরেজি অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায় – “If you do not respect a queen, respect an unhappy mother”, মানে “তুমি যদি একজন রানীকে সম্মান করতে না পারো, একজন অখুশি মা কে সম্মান করো।”

Luxembourg Gardens এর একটা হাইলাইটের কথা এখানে বলি। ১৬১২ সালে এই বাগান তৈরি হবার পর ১৬৩০ সালে Queen Marie de Medici এখানে একটা ঝর্না বানানোর আদেশ দেন। টমাস ফ্রান্সিনি, যিনি Medici র ফ্লোরেন্স এবং রোমের বাড়িতে ঝর্নার কাজ করেছিলেন, তিনি এখানেও ঝর্না বানানোর কাজে হাত দেন। ঝর্না তৈরি হল, কিন্তু কয়েকদিন কাজ করার পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়, আর সেই অবস্থাতে পড়ে থাকে ১৮১১ সাল অবধি। অবশেষে নেপোলিয়ন এই ঝর্না পুনরুদ্ধারের আদেশ দেন। এবার জিন চ্যালগ্রিন নামে এক স্থপতি কাজ শুরু করেন। জলের স্রোত ঠিক করার পাশাপাশি তিনি জুড়ে দেন এক সাদা মার্বেলমূর্তি, ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যের রোমান দেবী ভেনাসের।

ছবি তুলতে তুলতেই বৃষ্টি এসে পড়লো, ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলাম বাগান থেকে, যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, সেই একই রাস্তা ধরে।