যে সময়ের কথা আজ লিখতে বসেছি সেটা ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের কথা। ইউরোপ মহাদেশের অন্যতম প্রাচীন একটা শহরে একটা দিন নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ানোর গল্প। প্রচুর ছবি তুলেছিলাম সেই দিন। আজ সেই ছবিগুলো দেখতে বসে অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। কিছু স্মৃতি এতো টাটকা যে মনে হয় এই তো কালকের কথা। আবার কয়েকটা খুব আবছা, তিন বছরের ধুলো পুরু হয়ে জমতে শুরু করেছে তাদের ওপরে। তাই সময়ের সাথে বিস্মৃতির আরও অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই এই ব্লগ লেখার শুরু।
একদিনে কি প্যারিস দেখা সম্ভব? না, কিন্তু তাও আমি চেষ্টা করেছিলাম। আজ সেই চেষ্টারই গল্প বলবো তোমাদের। কি ভাবে পৌঁছলাম, কোথায় থাকলাম, কি খেলাম, কেমন ঘুরলাম – সব কিছু ধরা থাকবে ‘একদিনের প্যারিস’ এর আটটা পর্বে। আজ প্রথম পর্বে প্ল্যানিং এর খুঁটিনাটি।
সুযোগ এলো কি ভাবে?
সুযোগটা এসেছিল একটা ইমেইল মারফত, যেখানে পৃথিবীর সব দেশের বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রন জানানো হয়েছে প্যারিসে, একটা সন্মেলনে যোগ দেবার জন্য। আমি যে বিষয়ে গবেষণা করি, সেই বিষয়ের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি হবে এই সন্মেলন। কিন্ত যেহেতু আসন সংখ্যা সীমিত, তাই আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হবে কয়েক জনকে। চোখ বন্ধ করে দিলাম আবেদন করে। মাস কেটে গেলো, উত্তর আর আসে না। তারপর এল সুখবর, অক্টোবর মাসের প্রথমে। আমন্ত্রণ পত্র এসে পৌঁছল আমার ইমেইল এ। তার মানে যাত্রা করা যেতে পারে। সেই দিন থেকে যাবার এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত কাটল সব কাগজ পত্র তৈরি করতে – ভিসা হল, টিকিটও কাটা হল, ইউনিভার্সিটি থেকে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সারও আয়োজন হল। চিনে টাকা পরিবর্তন করে ইউরো নিলাম। ক্রেডিট কার্ড গুলো সঙ্গে নিয়ে নিলাম, বলা যায় না কোথায় কখন কাজে লেগে যায়। এই সময় বলা দরকার, উদ্যোগকারীরা অনেক সাহায্য করেছেন আমায়, যখন যে ভাবে চিঠির দরকার হয়েছে, পেয়েছি।
যাবার আগের প্রস্তুতি
এর মধ্যে আমি আরও একটা কাজ করলাম। ভালো করে চোখ বোলালাম সন্মেলনের সময় সূচিতে, যেটা শুরু হচ্ছে ১২ তারিখ থেকে আর চলবে ১৫ তারিখ অবধি – মানে মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার। আমি টিকিট কেটেছি এমনভাবে যাতে আমি পৌঁছব রবিবার রাতে, আর ফিরে আসার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে শনিবার বিকেলে। সন্মেলনটা যেখানে হচ্ছে, সেই জায়গাটার নাম Saint-Remy-les-Chevreuses। শহরের ম্যাপ দেখে যা বুঝলাম, জায়গাটা প্যারিস শহর থেকে অনেক দূরে, প্রায় গ্রাম বলা চলে। শহরের মেট্রো ম্যাপে সবচেয়ে লম্বা যে রুট, তার প্রথম স্টেশন হচ্ছে এয়ারপোর্ট আর শেষ স্টেশন এই জায়গাটা। প্রায় ১ ঘণ্টার ওপর সময় লাগে এক পিঠ যেতে। আশেপাশে কিছু নেই, একটা ট্রেন স্টেশন, বাস ডিপো, কিছু অল্প দোকান নিয়ে ছোট একটা গ্রাম। তার ওপর সন্মেলন চলবে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি, যার পর শরীর দিলেও, মন সায় দেবে না শহরে আসার। তাই যা করার, যা দেখার দেখতে হবে একদিনেই – সোমবার হতে হবে সেই দিন। মঙ্গলবার সকালে পৌছলেই হবে গ্রামে। তাই এবার ভালো করে পরিকল্পনা করতে বসলাম। একদিনে কিভাবে প্যারিস দেখা সম্ভব – কি কি দেখব, আর কি কি এবারের মত বাদ দেব।
যাতায়াত
প্রথমে বসলাম যাতায়াত নিয়ে। যে সব ওয়েবসাইট থেকে ইনফর্মেশন পেয়েছিলাম, তার একটা লিস্ট নীচে দিয়ে রাখব, যাতে পরে কাজে লাগে। এবারে আমার যাওয়া আর আসা দুটোই এয়ার চায়না তে। গুয়াংজু থেকে বেজিং হয়ে প্যারিস এর Charles De Gaulle (CDG) এয়ারপোর্ট । আরও একটা এয়ারপোর্ট আছে প্যারিস শহরে – Orly এয়ারপোর্ট। আমি পৌছব স্থানীয় সময় বিকেল ৫-৪৫ এ। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে শহরে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে সময় আর পয়সা দুই বেশি লাগবে, তাই স্থির করলাম ট্রেন এ যাব।
প্যারিস শহরে ১৬ টারও বেশি লাইন আছে, ৩০০ ওরও বেশি স্টেশন। এর মধ্যে যে লাইন টা শহরের কেন্দ্রস্থল কে আশেপাশের জায়গা গুলোর (যাকে ইংরিজিতে বলা হয়, suburb) সাথে যুক্ত করে, সেই লাইন টার নাম RER। দেখে বুঝলাম RER-B লাইন এর ট্রেন ধরতে হবে আমাকে CDG থেকে আর এই লাইনের শেষ স্টেশন হচ্ছে সন্মেলনের জায়গা। ট্রেন যাবে শহরের মধ্যে দিয়ে, এই মাথা থেকে ওই মাথা – মাঝে পড়বে প্যারিস শহর। শনিবার রাতে নেমে যদি আমি এই লাইনের মাঝের কোন স্টেশন এর আশেপাশে থেকে যেতে পারি, আর সেই জায়গাটা যদি শহরের মধ্যে হয়, তাহলে সুবিধা হবে। মাঝের স্টেশন গুলো দেখে ঠিক করলাম থাকা যেতে পারে St Michel/Nôtre Dame এর আশেপাশে। প্রচুর দেখার জিনিষ ছড়িয়ে আছে আশেপাশে, সোমবারটা ভালো ভাবে কাটানো যাবে। মঙ্গলবার সকালে বেরিয়ে আবার ওই স্টেশন থেকেই ট্রেন ধরে সোজা চলে যাব সন্মেলনের জায়গায়।

থাকা
যেমন ভাবা তেমন কাজ – এবার দেখতে হবে থাকার জায়গা। সন্মেলনের আয়োজকরা থাকার ব্যবস্থা করবেন শুধুমাত্র সন্মেলনের দিনগুলোর জন্যে (মানে ১২ থেকে ১৫) – তাই বাকি দিনগুলো আমাকে ভাবতে হবে।
১০-১২ তারিখ এর জন্য স্থির করলাম এমন একটা হোটেল দেখতে হবে, যেটা
- শহরের মধ্যে হয়, যেখান থেকে আমার ঘোরার জায়গাগুলো খুব দূরে না হয়
- কাছাকাছি ট্রেন স্টেশন থাকে (কারণ আমি এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেন ধরে শহরে যাবো)
- একটু ভালো, পরিষ্কার পরিছন্ন হয়, সারাদিনের ক্লান্তির পর যেন ঘুমটা ভালো হয়
এই তিনটে জিনিস যে হোটেলে পেলাম, তার নাম – Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés (ঠিকানা-14 Rue de la Sorbonne, Paris, France, 75005)। স্টেশন থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথ। সকালের ব্রেকফাস্ট complementary। ভাড়া ১৬৩২ RMB, সিটি ট্যাক্স পড়ল ৪৫ RMB – সব মিলিয়ে দু’দিনের ভাড়া পড়ল ১৬৭৭ RMB, মানে ২০৭ ইউরো।
এবার শেষ দিন। সেই দিনটা শহরে না ফিরে, সন্মেলন শেষ হবার পর ওই গ্রামেই থেকে যাব কোথাও। স্টেশনের কাছাকাছি থাকতে হবে কোথাও, কারণ পরের দিন আমি ট্রেন ধরে এয়ারপোর্ট আসবো। গ্রামে যে হোটেল পাবো না সেটা জানতাম, পেলাম একটা home stay। নাম chambre d’hôte (ঠিকানা- 4 rue Henri Janin, Saint-Rémy-lès-Chevreuse, France, 78470)। একদিনের ভাড়া ৩৭৮ RMB, সিটি ট্যাক্স পড়ল ২১ RMB – সব মিলিয়ে দু’দিনের ভাড়া পড়ল ৩৯৯ RMB, মানে ৫০.৬৪ ইউরো।
এখানে একটু বলে রাখি, ফ্রান্সে তিন ধরণের গেস্ট হাউস হয় – gite, chambre d’hotes, আর table d’hotes। gite হল অল্প সময়ের থাকার জন্য ফ্ল্যাট, বাড়ি বা কটেজ, যেখানে নিজেকে নিজের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়, যাকে ইংরেজিতে বলে self catering। chambre d’hotes হল এক রকমের gite, কিন্তু এখানে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা থাকে। একটা chambre d’hotes এ ম্যাক্সিমাম ৫টা বেডরুম থাকতে পারে, আর একসাথে ১৫ জনের বেশী অতিথি রাখার নিয়ম নেই। আর table d’hotes হল একরকমের chambre d’hotes যেখানে ব্রেকফাস্টের সাথে ডিনারের অপশন থাকে। কিন্তু সেখানেও কিছু নিয়ম আছে। যেমন ডিনারে একটাই মেনু থাকবে, সেটা স্থানীয় কোন খাবার হতে হবে, বা স্থানীয় কোন জিনিস দিয়ে বানানো খাবার হবে। এছাড়াও table d’hotes এ ডিনার দেওয়া হবে সেই বাড়ির খাবার টেবিলে, অতিথির ঘরে নয়।
ঘোরা আর খাওয়াদাওয়া
এবার আসল কাজ – কি ভাবে একদিনে প্যারিস দেখা যায়। হাতে আছে ১১ তারিখটা শুধু। পড়াশুনো করতে শুরু করলাম অবসর সময়ে। প্রচুর আর্টিকেল আছে ইন্টারনেটে, সেগুলো ভালো ভাবে পড়ে একটা লিস্ট বানালাম যে কোন কোন জিনিস না করলেই নয়ঃ
দেখতে হবে
- আইফেল টাওয়ার
- ল্যুভর মিউজিয়াম
- লুক্সেমবর্গ বাগান
- প্যান্থিয়ন
- টুইলেরিজ গার্ডেন
- নত্রে দামে চার্চ
- সেইন নদী
খেতে হবে
- Macaron
- ফ্রেঞ্চ Cuisine
অনেক জিনিস বাদ পড়ে গেলো, সেটা বুঝতে পারলেও আমার কিছু করার নেই। একদিনে এর বেশী করা সম্ভব নয়। মোবাইল এর ম্যাপ খুলে জায়গাগুলো মার্ক করলাম। যে অর্ডারে এখানে লিখলাম, সেই অনুযায়ী যেতে হবে, তার কোন মানে নেই। ম্যাপ দেখে ঠিক করলাম, হোটেল থেকে সকালে বেরিয়ে ল্যুভর যাবার পথে কিছু জিনিষ দেখবো, ল্যুভর থেকে আইফেল যাবার পথে কিছু, আর তারপরেও যদি শরীর দেয়, তাহলে ফেরার পথে কিছু। কি ভাবে গেছিলাম এই জায়গাগুলোতে, সেটা এর পরের পর্ব গুলোতে লিখবো।
তবে এখানে বলে রাখি, এই জায়গাগুলোর মধ্যে দুটো জায়গা এমন আছে যেখানে ভিড় হবে প্রচুর আর টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। টিকিটের জন্য লাইন দেওয়া মানে সব সময় ওখানেই চলে যাওয়া।অনলাইন টিকিট কাটা যায়, যেখানে দিন আর সময় নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। সেই মতো ১১ তারিখের সকালে ১২ টার সময় বুক করলাম ল্যুভর মিউজিয়াম আর দুপুর ৩টের সময় আইফেল টাওয়ার। ল্যুভর এর টিকিটের দাম পড়ল ১৭ ইউরো, আর আইফেল টাওয়ারের টিকিট ২৫.৫ ইউরো। আইফেল টাওয়ারের টিকিট আমি কেটেছিলাম একবারে ওপরে ওঠার জন্য। নীচের তলাগুলো অবধি উঠলে আরও একটু কম পড়তো।

