আগের পর্বে লিখেছিলাম হুয়াং পু বন্দরে পৌঁছনোর কথা, যে বন্দরের সাথে জড়িয়ে আছে ইতালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলোর নাম। সঙ্গে থাকলো ইতিহাসে পার্শ্বচরিত্র হয়ে থেকে যাওয়া এক মঙ্গোল রাজকন্যার কথা।
আজকে দ্বিতীয় পর্বে থাকছেঃ
- আমাদের ছোটবেলায় পড়া মার্কো পোলোর চীন ভ্রমণের শেষ কয়েকটা দিনের কথা
- কে ছিলেন Cocachin? শোনাবো এক মঙ্গোল রাজকন্যার ইতিহাস
- কি ভাবে দেশের এক অন্যতম ব্যস্ত বন্দর হারিয়ে যায় সময়ের স্রোতে, থাকলো সেই গৌরবময় সময়ের উপকথা
মার্কো পোলো এবং এক মঙ্গোল রাজকন্যা (A forgotten history of a Mongolian Princess)
অনেক ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম – দুই বন্ধুর বিচ্ছেদের কাহিনী। গল্পের দুই চরিত্র Marco Polo, এক ইতালিয়ান পর্যটক, আর কুবলাই খান, পৃথিবী বিখ্যাত মঙ্গোল সম্রাট। এটাকে গল্প বলা হয়ত ঠিক না, এটা Marco র ভ্রমণ কাহিনী ‘Travels of Marco Polo’ র কিশোর বাংলা অনুবাদ – তার শেষ অধ্যায়। Marco Polo র নাম তোমরা কমবেশি সবাই শুনেছ, তবুও বলে রাখি – এই ইতালিয়ান পর্যটক ১২৭১ থেকে ১২৯৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন। ইতিহাস Marco Polo কে মনে রেখেছে তার তৎকালীন চীন দেশ সম্পর্কে ভ্রমণ কাহিনীর জন্য। এই ২৪ বছরের মধ্যে ১৭টা বছর উনি কাটিয়েছিলেন চীন দেশে।
সেই সময় এই দেশে মঙ্গোল রাজত্ব। বিখ্যাত কুবলাই খান তখন শুধু চীন নয়, এশিয়া আর বর্তমান ইউরোপের অনেকটা জায়গার একছত্র অধিপতি। Marco Polo র নিজের কথায়, তিনি, তাঁর বাবা Nicolo, আর কাকা Maffeo, কুবলাই খানের খুব প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। সম্রাট তাঁদেরকে দেশে ফিরতে দিতে নারাজ। এমন সময় একদিন খবর এলো সুদূর পারস্য দেশ থেকে। পারস্য দেশ তখন কুবলাই খানের অধীনে, সেখানে তিনি শাসন ভার দিয়ে এসেছিলেন Ilkhanate khan Arghun এর হাতে। কেউ বলেন এই Ilkhanate khan Arghun কুবলাই খানের আত্মীয় ছিলেন, আবার কারুর মতে ইনি একজন স্থানীয় রাজা ছিলেন। যাই হোক না কেন, এই Ilkhanate khan Arghun এর সব থেকে প্রিয় বউ Buluqan Khatun দীর্ঘ রোগ ভোগের পর একদিন মারা যান। এই Buluqan Khatun ছিলেন বিখ্যাত মঙ্গোল Bayat উপজাতির। মারা যাবার আগে Buluqan Khatun স্বামীকে অনুরোধ করেন, যেন Ilkhanate khan Arghun আবার একজন Bayat উপজাতির মেয়েকেই বিয়ে করেন। স্ত্রীর শেষ অনুরোধ রাখতে Ilkhanate khan Arghun তিনজন দূত পাঠালেন কুবলাই খানের দরবারে, ১২৯১ সালে। কুবলাই খান রাজী হলেন, মেয়ে দেখা শুরু হল।
এর মধ্যে Marco Polo র সাথে এই তিন দূতের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। দূতেরা Marco Polo ও তাঁর বাবা-কাকাকে তাঁদের সাথে পারস্য দেশে যেতে অনুরোধ করেন। Marco Polo জানতেন কুবলাই খান সহজে রাজী হবেন না তাঁর এই প্রিয় বন্ধুকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছর পর Marco Polo রও মন টানছিল নিজের দেশের প্রতি। অনেক আলাপ আলোচনার পর অবশেষে কুবলাই খান অনিচ্ছা ভরে রাজী হলেন বন্ধুকে বিদায় জানাতে। মোট ১৪ টা জাহাজ রসদ আর অস্ত্রে পরিপূর্ণ করে কুবলাই খান বিদায় জানান Marco Polo কে Kaan-baligh শহর থেকে, যে শহরকে আজকে আমরা জানি Beijing বলে। কুবলাই খান দায়িত্ব দিলেন Marco Polo কে মেয়েটির খেয়াল রাখবার জন্য। চীন থেকে যাত্রা শুরু করে সুমাত্রা, শ্রী লঙ্কা, ভারতবর্ষ হয়ে দীর্ঘ ১৮ মাস পরে তাঁরা যখন পারস্য দেশে পৌঁছন, ততদিনে Ilkhanate khan Arghun মারা গেছেন। অবশেষে Ilkhanate khan Arghun এর ছেলে Gasan (বা Ghazan) এর সাথে এই মেয়েটির বিয়ে হয়। Marco Polo সেখান থেকে দেশে ফিরে যান।
এখানে আসার পর এই গল্পটা আবার আমার মনে পড়ে কয়েক বছর আগে Marco Polo নামে একটা Web Series দেখার পর। তখন আমি সবে সবে এখানে এসেছি, তাই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেছিলাম। গল্পটা পড়ে, বা Web Series টা দেখে, আমার কয়েকটা জিনিস মনে হয়েছিল। এক তো কুবলাই খানের সাথে Marco Polo র বন্ধুত্ব। ইতিহাস পড়তে বরাবর ভালো লাগে – তাই আরও বেশী করে টেনেছিল সেই সময়ে এই দেশটা কেমন ছিল, তার বর্ণনা।
কিন্তু সব থেকে বেশী মনে হয়েছিল এই পুরো ঘটনার কেন্দ্রস্থলে থাকা মেয়েটার কথা। সেই ১৭ বছরের মেয়েটা, যাকে চীন থেকে পারস্য দেশে পাঠাবার উপলক্ষে ছোটো হয়ে আসে Marco আর কুবলাই এর বন্ধুত্বের মেয়াদ। অনেক জানার চেষ্টা করেছিলাম মেয়েটার সম্পর্কে, কিন্তু কোথাও লেখা হয়নি মেয়েটি কেমন ভাবে গ্রহণ করেছিল নিজের দেশ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে, এমন একজনের সাথে নিজের জীবনটা কাটাতে যাকে চেনা বা চোখে দেখা তো দূরের কথা, যার নামই সে কোনোদিন শোনেনি। জীবনে প্রথমবার বাড়ি থেকে দূরে যাওয়া, তাও জলপথে – যার সম্পর্কে তার কোন ধারণাই তৈরি হবার অবকাশ পায়নি – কেমন হয়েছিল তার মনের অবস্থা? দীর্ঘ ১৮ মাসের যাত্রাপথে সে আর Marco কি একে ওপরের কাছাকাছি এসেছিল? একে ওপরকে ভালবেসেছিল? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না – আমরা জানি না। ইতিহাস তাকে এক পার্শ্বচরিত্র ছাড়া মনে রাখেনি। তার অসাধারণ রূপ বর্ণনার সাথে আমরা শুধু জেনেছি এই মঙ্গোল রাজকন্যার নাম – Cocachin (অথবা Kököchin, Kökechin, Kokachin or Cocacin)।

হুয়াং পু বন্দরের ইতিহাস (History of the Huang Pu ancient port)
যে রাস্তা দিয়ে বন্দরে এসেছিলাম, সেটা দিয়েই এবার ফিরে যাবার পালা। কিছু দূর এসে বাঁদিকে চোখে পড়ল Huangpu Ancient Port Museum। আসার আগে জেনে নিয়েছিলাম এই Museum টা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টে অবধি খোলা থাকে, শুধু সোমবার বন্ধ। আজ রবিবার, ঘড়িতে এখন বাজছে দুপুর ১২টা। তাই ঢুকতে কোন বাঁধা নেই। ঢুকতে কোন টিকিটও কাটতে হয় না। পুরনো দিনের Custom বিল্ডিং ছিল এটা, পরে এটাকেই Museum বানানো হয়েছে। ঢোকার সময় ব্যাগ চেক করার কথা, কিন্তু security guard দের দেখে মনে হল তাঁরা এই ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়। যাই হোক, Museum এর বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গেলে লেখা আরও লম্বা হয়ে যাবে। শুধু কয়েকটা কথা লিখে রাখি, তাহলেই হবে।
১৬৮৫ সালে, সম্রাট Kangxi র রাজত্বের ২৮ তম বছরে, গুয়াংজুতে বিদেশী বাণিজ্য তদারকির জন্য গুয়াংডং কাস্টমস প্রশাসন প্রতিষ্ঠা হয়, এবং বিদেশী জাহাজের উপর শুল্ক আরোপের জন্য Huangpu গ্রামে একটি অফিস তৈরি করা হয়। ১৭৫৭ সালে Qing রাজবংশের সময়, সম্রাট Qianlong দেশের সমস্ত কাস্টমস প্রশাসন বন্ধ করে গুয়াংডংয়ের কাস্টমস প্রশাসনকে একমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে মনোনীত করেন। যার ফলস্বরূপ Huangpu বন্দর ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য একটি ব্যস্ত এবং সমৃদ্ধ গন্তব্য হয়ে ওঠে। আগেই লিখেছি, ব্রিটিশরা ওপিয়াম বা আফিম যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরে, চীনের আরও বেশ কিছু বন্দর খুলে দেয় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ১৮৪২ সালে। সাংহাই হয়ে ওঠে বিদেশী বাণিজ্যের জন্য এক নম্বর বন্দর। সময়ের স্রোতে জমতে থাকে পলি, আর Huangpu বন্দরের সমৃদ্ধি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়, শুধু রয়ে যায় আজকের এই Museum সেই পুরনো দিনের গৌরবের সাক্ষী হয়ে।

তাই এই Museum এর দেওয়াল জুড়ে ছড়ানো রয়েছে সেই সব পুরনো দিনের ইতিহাস যখন গুয়াংজু ছিল Maritime Silk Road এর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অসংখ্য ছবির মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে কেমন ছিল এই বন্দরের জাহাজ নোঙর করার জেটি গুলো, কেমন ছিল এখানকার মানুষজনের জীবনযাত্রা। একটা দেওয়াল জুড়ে শুধুই হং ব্যবসায়ীদের কথা। পৃথিবীর এক বিশাল মানচিত্রে আলো দিয়ে দেখানো হয়েছে কিভাবে ১৭ থেকে ১৯ শতক অবধি Huangpu এর সাথে যুক্ত হয়েছিল পূর্ব থেকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা। ১৭৫৮ সাল থেকে ১৮৩৭ সাল অবধি মোট ৫১০৭ টা জাহাজ ভিড়েছিল Huangpu বন্দরে। কাঁচের শোকেজে সাজানো রয়েছে সেরামিক এর জিনিস থেকে শুরু করে অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ করা হাত পাখা। সেরামিক চীন দেশের অবদান পৃথিবীকে, তার ইতিহাস লিখে রাখা আছে খুব ছোটো করে। আর রয়েছে নৌবাণিজ্যের অন্যতম মূল উপাদান – জাহাজ। ছোটো থেকে বড়, সাধারণ থেকে জটিল – কতরকমের জাহাজের যে মডেল রাখা আছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ব্রিটিশরা একসময় হয়ে উঠেছিল পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্যের প্রধান কারিগর – তাদের প্রথম যে জাহাজ চীন দেশের বন্দরে ভিড়েছিল, তার নাম ছিল True Britain, সময়টা ১৭১৫ সাল। Macau বন্দর থেকে True Britain প্রথম নোঙর করে কিন্তু এই Huangpu বন্দরেই। সুইডেন এর রাজপরিবার ২০০৬ সালে Huangpu বন্দর ঘুরতে এসেছিলেন, সেই জন্যই বোধহয় সুইডিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্পর্কে প্রচুর তথ্য রয়েছে এখানে, বিশেষত বিখ্যাত সুইডিশ জাহাজ East Indiaman Gotheborg সম্পর্কে। তবে এসব জানা সম্ভব হত না, যদি না প্রত্যেকটা ছবি বা মডেলের নীচে ইংরেজি ক্যাপশন না থাকতো। স্বীকার করতে বাঁধা নেই, এটা আমি আশা করিনি। এর আগে যেখানেই গেছি, সব জায়গাতে দেখেছি শুধু চাইনীজে লেখা।

Museum দেখা শেষ করে যখন বেরলাম তখন ঘড়িতে বাজছে দুপুর ১টা। খিদে পেয়েছে একটু একটু, কিন্তু এখনও গ্রামটা দেখা বাকি। যে রাস্তা দিয়ে এসে বন্দরে ঢুকেছিলাম, এবার সেই রাস্তা দিয়ে ফিরে চললাম। এবার লক্ষ্য Huangpu গ্রাম, আর তার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মন্দির।