শুরুর কথা
ঘুরে এসেছি পার্ল নদীর পাড় দিয়ে। ব্রিজের ওপর থেকে দেখেছি শহরের ঝাঁ চকচকে রূপ, রাতের নিয়ন আলোয় যা আরও প্রাণবন্ত, আরও মোহময়। কিন্তু এই শহরের আরও একটা রূপ আছে, যেটা আমি কয়েকদিন আগে আবিষ্কার করেছি। অবাক হয়েছি এটা দেখে যে এখানকার অনেক লোকজন এই জায়গাটার সম্পর্কে অবগত নয়, বিদেশীদের কথা না হয় বাদ দিলাম। যারা জানে এই জায়গাটার কথা, তাদের বেশীর ভাগেরই খুব আবছা ধারণা রয়েছে এই জায়গার সাথে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসটার সম্পর্কে। আজকের এই লেখায় তাই শুধু নতুন জায়গা ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নয়, অল্প করে হলেও ধরা থাকলো গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস, যা বুকে নিয়ে এই জায়গাটা আজও বেঁচে আছে। ঘুরতে আসা দেশ-বিদেশের ট্যুরিস্টদের যে শোনাতে চায় তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কাহিনী।
আজকে প্রথম পর্বে থাকছেঃ
- ক্যান্টন, এক সময় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শহর
- ক্যান্টন শহরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক বন্দর, হুয়াং পু
শুরুর কথা
ফটোগ্রাফি শিখছি বেশ কিছুদিন হল। সন্ধ্যে যখন রাতের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয় আস্তে আস্তে, আমি বেরোই ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে। কোনোদিন হেঁটে, কোনোদিন বাইকে। সেই একই জায়গা, একটু এদিক ওদিক করে নিয়ে tripod রেখে রাতের শহর ফ্রেম বন্দী করে বাড়ি আসি। ইচ্ছে করে নতুন কিছু করি, রাতের পাশাপাশি দিনের ছবি তুলি। সোম থেকে শুক্র অফিস করে, আর শনিবার ঘর পরিষ্কারের কাজ করে, রবিবার আর বেরোতে ইচ্ছে করে না। বই পড়ে রবিবারের অনেকটা সময় কেটে যায়। ইতিহাস বই পড়তে ভালো লাগে। কয়েকদিন আগে একটা বই পড়ছিলাম – নাম Imperial Twilight, লেখক Stephen Platt। চীনের সাথে ব্রিটিশদের হওয়া প্রথম ওপিয়াম যুদ্ধের ওপর লেখা বই। বইয়ের প্রথম ৫টা অধ্যায় জুড়ে একটা শহরের নাম ঘুরে ফিরে আসে – ক্যান্টন, যে শহর আজকে পরিচিত গুয়াংজু নামে, যে শহরে আমি আজ থাকি।
ক্যান্টন শহর – একসময়ের বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শহর (Canton, today’s Guangzhou)
ক্যান্টন লিখে গুগল সার্চ করলে অনেক লেখা পাওয়া যাবে। Stephen Platt তাঁর বইতেও পুরনো দিনের গুয়াংজু বা ক্যান্টনের খুব ভালো বর্ণনা দিয়েছেন। যদি তোমরা কেউ বিশদে জানতে চাও, বইটা পড়ে দেখতে পারো। এখানে আমি অল্প একটু লিখি যতটা এই পর্বের জন্য, যে জায়গার কথা বলতে যাচ্ছি তার সম্পর্কে একটা ধারণা করার জন্য, যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়।
১৮ শতকের শেষের দিক। ১৬৪৪ সালে ছিং (ইংরেজিতে লিখলে Qing) রাজবংশ চীনের ক্ষমতায় আসার পর কেটে গেছে আরও দুটো শতক। ছিং সামাজ্র্যের সূর্য তখন মধ্য গগনে। ১৯১২ সাল আসতে তখনও অনেক দেরী, যখন ২৬৮ বছরের এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে আজকের গণতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠা হবে। সেই সময় ক্যান্টন ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শহর – লন্ডন আর বেইজিং এর ঠিক পরেই। দক্ষিণ চীন সাগরের পারে অবস্থিত এই বন্দর শহর তখন সমগ্র চীন দেশের মধ্যে একমাত্র শহর ছিল যেখানে বিদেশীদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার ছিল। বিদেশীদের সাথে বাণিজ্যের জন্য একচেটিয়া অধিকার দেওয়া ছিল কিছু চীনা বাণিজ্যিক পরিবারকে। এদের বলা হত হং (ইংরেজিতে Hong merchants)। এত বড় ক্যান্টন শহরে হং ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ জনের মতো। তুমি যদি কোনও বিদেশী জাহাজের ক্যাপ্টেন হও, তাহলে তোমার ব্যবসার জিনিসপত্র ক্যান্টনে ঢোকার আগে হং ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সেই তোমাকে গুদামের জায়গা ভাড়া দেবে, তোমার জিনিস বিক্রি করতে সাহায্য করবে। তুমি যদি চা বা সিল্ক আমদানি করতে চাও, এই হং ব্যবসায়ী একমাত্র পারে সেটা তোমার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে। পুরো ক্যান্টন শহরে অসংখ্য বন্দর থাকলেও কয়েকটা মাত্র বন্দরই খোলা ছিল বিদেশী জাহাজের নোঙর করার জন্য। আর এমনই একটা বন্দর ছিল হুয়াং পু বন্দর।

হুয়াং পু বন্দর – কোথায় এবং কি ভাবে গেলাম (Huang Pu ancient port – how to go there)
গুয়াংজু শহরে মাটির নীচে মোট ১৪ টা মেট্রো লাইন আছে। তার মধ্যে মেট্রো লাইন ৮ এর একদিকে রয়েছে Fenghuang Xincun স্টেশন আর অন্যদিকে Wanshengwei স্টেশন। এই Wanshengwei স্টেশনে নেমে B গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ডান দিকে কিছুটা হাঁটলেই একটা বাস স্টপ আছে। এই বাস স্টপ থেকে ২২৯ নম্বর বাস নিয়ে যায় তিনটে স্টপেজ পরে হুয়াং পু গ্রামে। এটাই ২২৯ নম্বর বাসের শেষ স্টপেজ। আমি যেদিন এই গ্রাম ঘুরতে গেলাম, সেদিন ছিল রবিবার। ইউনিভার্সিটি যাবার নেই। যদিও ইউনিভার্সিটির সামনে দিয়ে গেছে মেট্রো লাইন ৮, আর আমার এপার্টমেন্টের সামনে এখনও কোন মেট্রো লাইন হয়নি, কাজ চলছে। তাই ঠিক করলাম বাসেই যাবো। বাড়ির সামনেই বাস স্টপ, সেখান থেকে ২২৯ নম্বর বাসে যখন চেপে বসলাম, তখন ঘড়িতে বাজে সকাল ১০ টা। বাড়ি ফিরে লাঞ্চ করবো, এই ঠিক করে বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা আর এক ফ্লাস্ক কফি নিয়ে।
২ RMB ভাড়া দিয়ে, প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা পর নেমে পড়লাম এই রুটের শেষ স্টপেজে, যার নাম PaZhou ShiJiCun ZongZhan। ইংরাজিতে লিখলাম, কারণ এখানে অধিকাংশ বাস স্টপের কোন ইংরাজি নাম নেই। যাই হোক, এখানে নেমে পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আজ রবিবার, অনেক টুরিস্টের ভিড়। তাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চললাম Xingang East Shiji Ring Road ধরে। রাস্তার দু’পাশে অনেক দোকান – কোথাও সব্জি-ফল বিক্রি হচ্ছে, তো কোথাও কাঁচের বোতলে মধু। কেনা বেচা চলছে পুরোদমে, স্থানীয় লোক থেকে শুরু করে আজ ঘুরতে আসা লোকজন – সবাই একই রকম ব্যস্ত এই বাজারে। ভিড় বাঁচিয়ে কিছুদূর যেতেই রাস্তাটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আসার আগে ম্যাপে যা দেখেছিলাম, তা যদি ঠিক হয়, তাহলে ডান দিকের রাস্তাটা চলে গেছে বন্দরের দিকে, আর বাঁদিকের রাস্তাটা গ্রামের দিকে। আমি প্রথমে ধরলাম ডান দিকের রাস্তাটা – পুরনো দিনের সেই বন্দরের উদ্দ্যেশে, যেখানে এসে নোঙর করতো বিদেশী জাহাজ।

পৌঁছলাম হুয়াং পু বন্দরে (Huang Pu ancient port – First impression)
রবিবারের সকালে বাজারে গেলে যেরকম অনুভূতি হয়, প্রাচীন বন্দরের দিকে পাথরে বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে যাবার সময় একই রকম মনে হচ্ছিল। রাস্তার দু’পাশে স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানে হরেক জিনিসের পসরা সাজানো। মাছমাংস থেকে শুরু করে শাকসব্জি – কি নেই সেখানে? প্রায় ১০ মিনিট হেঁটে যেখানে উপস্থিত হলাম, সেখানে রাস্তাটা ডাঙ্গায় তার যাত্রা শেষ করে নদীতে নেমে গেছে। নদী বলছি বটে, কিন্তু খাল বললেও খুব ভুল হত না। এটা Pearl নদীর একটা ছোট শাখা মাত্র, নাম Huangpuchong। সামনে নদীর পাড়ে ঘাটের ওপর মাছ বিক্রেতাদের ভিড়। কয়েকটা ছোট ডিঙ্গি নৌকো নদীর বুকে এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে – মাছের আশায় নিশ্চয়ই। বাঁদিকে একটা পাঁচিলের গায়ে একটা ছোট ফলক লাগানো – এই জায়গাটার নাম লেখা। ডানদিকে তাকালে নদীর আরও কিছুটা অংশ চোখে পড়ে। জায়গায় জায়গায় কচুরিপানার ভিড়। কয়েকটা পুরনো জাহাজের খোল তার মধ্যেই হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। আরও কিছুদূর চোখ যায়, তারপর নদীও বাঁকের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। সমস্ত জায়গাটায় কেমন একটা আঁশটে গন্ধ, অথবা হয়তো অবহেলার গন্ধ। সময়ের হাতে ইতিহাস পাল্টানোর গন্ধ। নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে ভাবতে অবাক লাগছিল, একদিন এই ঘাট দিয়ে উঠে নেমে গেছে কতো মানুষ, কি বা তাদের পরিচয়, কোন দেশের লোক তারা – কতো গল্পই না জমে আছে নদীর পাড়ে জেগে থাকা এই কয়েকটা ঘাটের সিঁড়িতে – কেই বা জানতে চায়? কারই বা শোনার সময় আছে আজ? সময় ভোলাতে বসেছে সব কিছু, একটা একটা করে ঘাটের সিঁড়ি হারিয়ে যাচ্ছে নদীর বুকে, দূরে মাথা তুলছে সর্বগ্রাসী নগর সভতা।

হতাশ লাগছিল। এসেছিলাম গল্প শুনতে। কিচ্ছু নেই। ফেরার আগে পুরনো জাহাজের খোল গুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা জাহাজের গায়ে লেখা আছে, Cocachin। বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ে গেল, অনেকদিন আগে পড়া একটা গল্প।
[…] আগের পর্বে লিখেছিলাম হুয়াং পু বন্দরে পৌঁছনোর কথা, যে বন্দরের সাথে জড়িয়ে আছে ইতালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলোর নাম। সঙ্গে থাকলো ইতিহাসে পার্শ্বচরিত্র হয়ে থেকে যাওয়া এক মঙ্গোল রাজকন্যার কথা। […]