“ক্রেডিট কার্ড সঙ্গে আছে তো? কিছু RMB থেকে USD করে নিও এয়ারপোর্ট থেকে। কাজে লাগতে পারেে।” স্যার বললেন। আমি ওনাকে টেক্সট করেছিলাম এটা জানাতে যে আমি ঠিকঠাক পৌঁছে গেছি এয়ারপোর্ট।
“হ্যাঁ স্যার, করে নেবো আজকে রাতেই”, আমি বললাম। আমি যেখানে বসেছি, তার সামনে একটাই দোকান খোলা আছে, আর সেটা Money Exchange এর। ভাবলাম, এখনই করিয়ে নি। পরে সময় পাবো কিনা জানি না।
পিঠের ব্যাগে ক্রেডিট কার্ড এর ব্যাগটা খুঁজতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। আনিনি। শুধু ক্রেডিট কার্ড নয়, ওই ব্যাগে আমার ইন্ডিয়ার কার্ড গুলোও আছে – ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড। মানিব্যাগ ব্যবহার করার অভ্যেস একদম চলে গেছিলো, সব কিছু মোবাইল দিয়েই হয়ে যেতো। সেই জন্যই এই ভুলটা হয়েছে। পরক্ষণেই মনে হল, ডলার তো আমার লাগবে না, শুধু শুধু RMB গুলো খরচ করবো কেন? পরে অবশ্য এই ভুল আমার ভেঙেছিল, কিন্তু তা হল, যাকে বলে যথাস্থানে প্রকাশ্য।
শক্ত চেয়ারে কখনও সোজা হয়ে বসে, কখনও সামনে সুটকেসটা রেখে তার ওপর পা তুলে দিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে লাগলাম। সঙ্গী বলতে কিছু বই আর গান। খিদে পেলে একটু করে বাদাম খাই, যে প্যাকেটটা বাড়ি থেকে ল্যাপটপের ব্যাগে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মুখ থেকে মাস্ক নামালেই টহলরত পুলিশ এসে বলে, মাস্ক পড়ুন। যাই হোক, এই ভাবে এক সময় সকাল হল। ব্রাশ করে এসে একটু চা-কফির দোকান খুঁজলাম, পেলাম না। অগত্যা একটু গরম জল খেয়ে আবার বসে থাকা, কখন ৮টা বাজবে। প্লেন যদি ১১টায় হয়, তিন ঘণ্টা আগে চেক ইন শুরু হবার কথা। অবশেষে চেক ইন শুরু হল ৮ নম্বর গেট থেকে। আর সেই চেক ইনের সময় খেলাম পরের ধাক্কাটা।
বোর্ডিং পাস নেবার সময় কাউন্টারের ছেলেটি বলল, “আপানার থাইল্যান্ডের ভিসা কোথায়?”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমি তো থাইল্যান্ড যাচ্ছি না। ব্যাংকক থেকে কলকাতা যাবো।”
“হ্যাঁ, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এখান থেকে Cathay Pacific এ যাচ্ছেন হং কং, সেখান থেকে ব্যাংকক, সেখান থেকে Indigo র ফ্লাইটে কলকাতা – তাই তো? যেহেতু Cathay Pacific এর সাথে Indigo র টাই আপ নেই, তাই আপনাকে ব্যাংকক এ নেমে নিজের লাগেজ নিতে হবে, তারপর আবার নতুন করে চেক ইন করতে হবে। সেই জন্য থাইল্যান্ডের ভিসা প্রয়োজন। আমরা এখান থেকে ব্যাংকক – কলকাতা রুটের বোর্ডিং পাস দিতে পারি না।”
স্বীকার করতেই হল, “এটা তো আমি জানতাম না। আমার কাছে তো থাইল্যান্ডের ভিসা নেই। কি করবো তাহলে?”
ছেলেটা আরও কিছুক্ষণ কম্পিউটারে দেখে নিয়ে বলল, “আপনি তো ভারতীয়। ভারতীয়রা ব্যাংকক এয়ারপোর্ট থেকে ভিসা করতে পারে।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ জানি। Visa on Arrival।”
“হ্যাঁ, ভিসা পেতে আপনার খরচ হবে ২০০০ ভাট মতো, থাইল্যান্ডের কারেন্সি। আপনার কাছে ক্যাশ আছে তো? RMB বা USD?”
মিথ্যে বলতেই হল, “হ্যাঁ আছে।”
ছেলেটি বলল, “তাহলে ঠিক আছে। আপনি এখান থেকে বা হংকং থেকে RMB বা USD টা পালটে ভাট করে নেবেন। তারপর ব্যাংকক এয়ারপোর্টে নেমে ভিসা করিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে লাগেজ নিয়ে একবার বাইরে গিয়ে আবার ভেতরে এসে চেক ইন করবেন। আমি আপনাকে দুটো বোর্ডিং পাস দিচ্ছি – একটা এখান থেকে হংকং, আর একটা হংকং থেকে ব্যাংকক। Wish you a pleasant journey, Sir.”
কি করে pleasant journey হবে জানি না। ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিয়ে, লাগেজ জমা দিয়ে লাইনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। Emigration শেষ করে, বোর্ডিং গেট যখন খুঁজে পেলাম তখন ঘড়িতে বাজে সকাল সাড়ে ৯টা। ভাবতে শুরু করলাম কি করা যায়।
থাইল্যান্ডের Visa on Arrival এর ফর্ম অনলাইনে আছে, সেটা একবার ভর্তি করলাম। কিন্তু সেখানে অনলাইন পেমেন্ট করতে হবে, আর শুধুমাত্র ভাট দিয়েই। তারপর মনে হল, আগে ব্যাংকক তো পৌঁছে যাই, তারপর RMB থেকে USD, আর তারপর USD থেকে ভাট করে নেওয়া যাবে। কিন্তু তার জন্য ক্রেডিট কার্ড চাই, যেটা এখন আমার কাছে নেই। তৃতীয় উপায় হল, হংকং পৌঁছে সেখানে এই money exchange এর কাজটা করে নেওয়া। সেখানেও ক্রেডিট কার্ড লাগবে, কিন্তু একটা আশা আছে হয়তো মোবাইল দিয়েও কাজ হবে। আমার মোবাইলে ক্রেডিট কার্ড গুলো অ্যাড করা আছে, পেমেন্ট করতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু যদি হংকং এ পৌঁছে দেখি, সেখানে মোবাইল দিয়ে পেমেন্ট করার অপশন নেই, তাহলে কি হবে?
তাহলে শেষ এবং একমাত্র উপায় হল, এখান থেকে সব কাজ করে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এখন ঘড়িতে বেজেছে ১০টা। আর ১৫ মিনিট পরে হংকং যাবার প্লেনে ওঠা শুরু হবে। এখানে কোথায় money exchange এর কাউন্টার আছে, সেটা খুঁজতে হবে। আফসোস হচ্ছিল খুব, কেন কাল সারা রাত money exchange এর কাউন্টারের সামনে বসে থাকা সত্ত্বেও এই কাজটা করে রাখলাম না। আর তার সাথে একটু একটু করে বাড়ছিল টেনশন। নিজেকে বোঝালাম, এই পরিস্থিতিতে মাথাটা ঠাণ্ডা রাখাটা খুব দরকার।
যাত্রীরা একে একে লাইন দিতে শুরু করেছে বোর্ডিং গেটের সামনে। আর দশ মিনিট পর থেকে হয়তো বোর্ডিং শুরু হবে। আমি আর দাঁড়ালাম না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে money exchange এর কাউন্টার খুঁজতে শুরু করলাম। ৫ মিনিট হাঁটার পর একটা চোখে পড়ল, কিন্তু সেটা বন্ধ। দোকানের সামনে চাইনীজ ভাষায় কিছু একটা লেখা, সেটাও বুঝতে পারলাম না। শুধু একটা তীর চিহ্ন ডানদিক নির্দেশ করছে। সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। পায়ের গতির সাথে বাড়ছে বুকের ধুকপুকুনিটাও। কয়েক পা হাঁটার পর চোখে পড়ল দোকানটা। কাউন্টারে একটি মেয়ে।
হাই, হ্যালো করার সময় নেই, দোকানে ঢুকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, “RMB থেকে USD করতে চাই, পেমেন্ট করবো মোবাইল দিয়ে – হবে?”
মেয়েটি জানালো, “হ্যাঁ হবে।”
“আর RMB থেকে Bhat – সেটা হবে?”
“হ্যাঁ, সেটাও হয়ে যাবে, স্যার।”
আমি বললাম, “আমার ২০০০ ভাট লাগবে।”
মেয়েটি হিসেব করে বলল, “৪১০ RMB, স্যার।”
“ঠিক আছে। আর তার সাথে ৫০ USD করে দিন।” হাতে একটু USD রেখে দেওয়া ভালো, কখন আবার কোথায় কাজে লাগে।
“ঠিক আছে স্যার, করে দিচ্ছি।”
“একটু তাড়াতাড়ি করবেন। আমার প্লেন ছাড়বে একটু পরেই।”
মেয়েটি খুব তাড়াতাড়ি কাজ করলো, কিন্তু money exchange এর সময় অনেক ফর্মালিটি থাকে। পাসপোর্টের জেরক্স করা থেকে শুরু করে money exchange এর একটা সার্টিফিকেট দেওয়া – অনেক কিছু। তাই খুব তাড়াহুড়ো করেও ১০ টা ৪৫ এর আগে সব কাজ শেষ হল না। হাতে টাকা, পাসপোর্ট আর গুচ্ছের কাগজ নিয়ে যখন বোর্ডিং গেটের দিকে দৌড়তে শুরু করলাম তখন ঘড়িতে ১১ টা বাজতে আর ৫ মিনিট বাকী।
গেটের সামনে যখন পৌঁছলাম, তখন বেশীর ভাগ বোর্ডিং শেষ। গেট বন্ধ হয়ে যাবার কথা প্লেন ছাড়ার ১৫ মিনিট আগে। বিশেষ করে Cathay Pacific এর মতো বড় airlines এর ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয় খুব কঠোরভাবে। কিন্তু সেদিন তখনও গেট খোলা।
গেটের সামনে পৌঁছতে উত্তরটা পেলাম। Cathay Pacific এর এই প্লেনটা CX982 হয়ে আসে হংকং থেকে গুয়াংজু, তারপর এখান থেকে CX983 হয়ে আবার উড়ে যায় উল্টোমুখে। আজ CX982 দেরী করেছে আসতে, হংকং এর আবহাওয়া খারাপ থাকার জন্য। তাই এখান থেকেও ছাড়তে ১৫ মিনিট দেরী হচ্ছে। আর সেই জন্যই গেট ১০ টা ৪৫ মিনিটে বন্ধ না হয়ে ১১ টায় বন্ধ হবে।
জেট ব্রিজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে তাকালাম – কেউ নেই, সবার শেষে উঠছি আমি। প্লেনে ঢোকার সাথে সাথে আমার পেছনে বন্ধ হয়ে গেলো Cathay Pacific CX983 এর বিশাল দরজাটা। যাত্রা শুরু হল হংকং এর উদ্দ্যেশে।

গুয়াংজু থেকে হংকং আর হংকং থেকে ব্যাংকক – এই সময়টুকুর স্মৃতি আজ বড়ই আবছা। যতো সময় গড়িয়েছে, শেষ এক মাসের মানসিক চাপ একটু একটু করে হাল্কা হয়েছে, আর সুযোগ বুঝে ঘুম এসে ভর করেছিল দু’চোখের পাতায়। তাই যতটা সময় আকাশপথে কাটিয়েছি, ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। আজ সত্যি মনে নেই, গুয়াংজু থেকে হংকং যাবার প্লেনে কি খেতে দিয়েছিল, কেমন লেগেছিল ১৭ ঘণ্টা পর আবার শক্ত কোন খাবার খেতে। হংকং এয়ারপোর্ট ঘোরার খুব ইচ্ছে ছিল, একটু বোধ হয় এদিক ওদিক ঘুরেওছিলাম, কিন্তু বিশদে আজ কিছুই মনে পড়ে না। স্মৃতির অন্ধকারে জোনাকির আলোর মতো জেগে আছে হংকং থেকে ব্যাংকক যাবার প্লেনের জানালার ধারে সেই সীটটা, প্লেনের গর্জন, আর তার বিশাল ডানার নীচে সরু ফিতের মতো মিলিয়ে যাওয়া রানওয়েটা।
