ভালো থেকো: পর্ব ২ – না যাওয়া যত পথ

এই গল্পটা আমার বাড়ি ফেরার - করোনা পরবর্তী সময়ে চীন থেকে ভারত - প্রায় তিন বছর পরে। দ্বিতীয় পর্বে কোভিডের প্রত্যাবর্তন আর কুখ্যাত স্থানীয় লকডাউন - একবার উঁকি মারা শহরের বুকে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্পের ভেতরে, যেখানে আমাকে যেতে হয়েছিল টানা ৩৬ দিন। আর সব শেষে আমার দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়া।

ধাক্কাটা এলো নভেম্বর মাসে। এর মাঝখানে বাড়িতে যখনই কথা হয়েছে, আমার আসার ব্যাপার ছাড়া আর কোন কথা নেই। আমি আসলে কি কি হবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে – এই সব নিয়ে হত আলোচনা। আমি কলকাতা যাবার পর নি আসবে ব্যাঙ্গালোর থেকে, সেটাও ঠিক হয়ে গেলো। চি আরও বেশী খুশী। অনেক দিন হয়ে গেলো আমরা দুজন একসাথে কোথাও ঘুরতে যাইনি। হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে ট্রেন-প্লেনের টিকিট কাটা হল শান্তিনিকেতন আর দার্জিলিং যাবার জন্য।

কদিন থেকেই খবর পাচ্ছিলাম গুয়াংজুতে কোভিড আক্রান্ত লোকের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। টেস্টিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় দেখলাম কিছু অস্থায়ী ক্যাম্প করা হয়েছে ইউনিভার্সিটির কিছু জায়গায়। এখানে রোজ যেতে হবে কোভিড টেস্টিং এর জন্য – ইউনিভার্সিটির ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী – সবাইকে।

ফাঁকা ক্যাম্পাস

এর পর থেকে একমাসেরও বেশী সময় ধরে প্রতিদিন যেখানে আমি গিয়ে দাঁড়াতাম, দিনের কিছুটা সময় ব্যয় করতাম, সেই জায়গাটা সম্পর্কে একটু বলা দরকার।

প্রতিটা ক্যাম্পের দুটো অংশ থাকতো। বাইরের অংশে মানুষ লাইন দেবে, আর ভেতরের অংশে দেবে স্যাম্পল। স্যাম্পল বা নমুনা নেওয়া হতো মুখ থেকে। স্বেচ্ছাসেবক দল সদা প্রস্তুত লাইনে দাঁড়ানো দু’জন মানুষের মাঝে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে। এই লাইন কোন কোন দিন এতো লম্বা হত যে আমার আগে অন্তত শ’খানেক লোক থাকতো। কিন্তু লাইন এগুতো খুব তাড়াতাড়ি।

বাইরে থেকে ভেতরে অংশে ঢোকার মুখে একজন স্বেচ্ছাসেবক দাঁড়িয়ে থাকতো। তার হাতে থাকতো একটা কাগজে প্রিন্ট আউট করা QR কোড। সেই কোড স্ক্যান করে, একটা ফর্মে নাম, পাসপোর্ট নাম্বার ভরে জমা দিলে আমার মোবাইলে একটা QR কোড আসতো। এবার সেই QR কোড সমেত মোবাইল হাতে নিয়ে লাইন ধরে প্রবেশ করা।

স্যাম্পল দিতে যাবার ঠিক আগে আর একজন স্বেচ্ছাসেবক আমার মোবাইলে থাকা QR কোডটা স্ক্যান করে নিতো।দশ জনের স্যাম্পল একটা জায়গায় নেওয়া হতো। তাই লাইনে দাঁড়ানো এক নম্বর ব্যক্তির পর ১১তম ব্যক্তির হাতে একটি ছোটো শিশি দেওয়া হতো, যার মধ্যে লাল রঙের একটা কেমিক্যাল থাকতো। সেই শিশি নিয়ে কিছু দূরে বসা ডাক্তারের কাছে যাওয়া। ডাক্তারবাবু একটা ইয়ার বাডের মতো জিনিস মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে, ভালো করে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে স্যাম্পল নিতেন। তারপর বাডের মুখটা ভেঙ্গে ওই শিশির মধ্যে রাখা কেমিক্যালে ডুবিয়ে দিতেন। এর পরের ন’জনের স্যাম্পলও ওই একই শিশির মধ্যে রাখা হতো। পরে সেই কেমিক্যালের পরীক্ষায় পসিটিভ রেজাল্ট এলে, এই ১০ জনকে আলাদা করে ডেকে এক এক জনকে পরীক্ষা করা হতো।

তৃতীয় এবং শেষ ধাপে, স্যাম্পল দিয়ে বেরনোর সময় আবার একটা QR কোড স্ক্যান করে জানাতে হতো আমি আজ টেস্টিং করিয়েছি। টেস্টিং সকাল ১২টার মধ্যে করালে সেই দিন রাতের মধ্যে রিপোর্ট আসতো। সেই রিপোর্টও আসতো QR কোড হয়ে। কোভিড নেগেটিভ হলে কোডের রং সবুজ, সন্দেহজনক হলে হলুদ, আর পসিটিভ হলে লাল – এই তিন রকম রঙের অপশন ছিল। পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার মুখে সবুজ রঙের কোড দেখিয়ে তবে ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলতো।

একদিন জানলাম ইউনিভার্সিটির ভেতরে স্টুডেন্ট হস্টেলে প্রচুর পসিটিভ কেস পাওয়া গেছে। খুব প্রয়োজন না হলে, আমরা যারা বাইরে থাকি, এখন ইউনিভার্সিটিতে আসার দরকার নেই। আমার কাজ আমি বাড়ি থেকেই করতে পারি, তাতে অসুবিধে নেই। কিন্তু সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। আমাকে তো বাজার হাট করতে বাইরে বেরোতেই হবে।সবুজ QR কোড না দেখালে কোন দোকান, বাজার, সুপারমার্কেট আমাকে ঢুকতে দেবে না। তার ওপর আমি যে এপার্টমেন্টে থাকি, সেখানে ঢুকতে গেলেও সবুজ কোড দেখাতে হবে। আর এই সবুজ কোড ২৪ ঘণ্টার পুরনো হলে চলবে না। তার মানে আমাকে রোজ টেস্টিং করাতে হবে।

স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি করবো। উনি জানালেন আমার এপার্টমেন্টের ঠিক বাইরে একটা ক্যাম্প হয়েছে। সেখান থেকে টেস্ট করাতে। পরে হিসেব করে দেখেছি, এরকম টেস্টিং করিয়েছি আমি টানা ৩৬ দিন। পুরোটাই বিনামূল্যে।

ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়ামে কোভিড টেস্টিং ক্যাম্প

আমি গুয়াংজু শহরের যে জায়গাটায় থাকতাম, সেটা Haizhu জেলার মধ্যে পড়ে। আগের একটা লেখায় লিখেছি এখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি শুরু হল পুরো Haizhu জেলা জুড়ে লকডাউন। স্কুল, কলেজ, বাস, ট্রেন, সব বন্ধ। কয়েকটা সুপারমার্কেট শুধু খোলা থাকতো। যত আমার যাবার দিন এগিয়ে আসতে লাগলো, তত বাজে খবর চারপাশ থেকে আসতে আরম্ভ করলো। এতো সংখ্যক লোক আক্রান্ত যে হাসপাতালে জায়গা নেই। তাই ঠিক হল, কোভিড আক্রান্ত হলে রুগীকে বাড়িতেই রাখতে হবে, আর সেই বাড়ি সাত দিনের জন্য সরকার বন্ধ করে দেবে। প্রতিদিন নিয়ম করে রুগীর পরিচর্যা সরকারের পক্ষ থেকে করা হবে, যেমন দিনে দু’বার করে টেস্টিং, খাবারদাবার, জল পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু বাড়ি এই শহরে কোথায়? সবই তো এপার্টমেন্ট আর তার ভেতরে ফ্ল্যাট। কোন ফ্ল্যাটে রুগী থাকলে সেই ফ্ল্যাট তো বটেই, পুরো এপার্টমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হতে লাগলো।

একদিন রাত ১১ টায় স্যার আমার ফ্ল্যাটে এসে হাজির। তাঁর এপার্টমেন্টে আজকে একজন কোভিড পসিটিভ ধরা পড়েছে, তাই সমস্ত এপার্টমেন্ট আগামী এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ। স্যারকে তো অফিস যেতে হবে, তাই উনি কিছু জামা কাপড় একটা সুটকেসে ভরে একটা সপ্তাহের জন্য আমার এপার্টমেন্টে থাকবেন। ওনার স্ত্রী আর ছেলে ওখানেই বন্ধ থাকবেন এক সপ্তাহের জন্য, যতদিন না পরিস্থিতি ঠিক হয়। এই ভাবে একটা সপ্তাহ গেলো।

আর একদিন সকালে টেস্টিং করাতে বেরিয়ে দেখি আমি যে এপার্টমেন্টে থাকি, তার উলটোদিকের এপার্টমেন্টটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। Do Not Enter লেখা ফিতে লাগানো গেটের মুখে, বাইরে দু’জন পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। গেটের বাইরে একটা জায়গায় এপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের জন্য খাবার, জল রাখা। যখনই নিজের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বাইরে বেরতাম, এই দৃশ্য চোখে পড়তো। মনে হতো, যদি এই এপার্টমেন্টের কেউ আক্রান্ত হয়, তাহলে তো আমারও এই দশা হবে। কোভিড আমার দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে।

নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হল না। রাস্তায় লোকজন নেই, যানবাহন চলাচল নেই, কোন দোকান খোলা নেই। শুধু কিছু দূরে দূরে চোখে পড়তো সাদা তাঁবু – টেস্টিং এর ক্যাম্প। সমস্ত শহর এক প্যারালাইসড রুগীর মতো পড়ে থাকলো – কি করবে, কি ভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করবে, কেউ জানে না। সারা পৃথিবী যখন কোভিড পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে, এই শহর ফিরে চলেছে অন্ধকারের দিকে, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। প্রতিদিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় মোবাইলে মেসেজ আসতো – আজ আক্রান্তের সংখ্যা এতো ছাড়াল, এই সব জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হল, সরকারের সাথে সহযোগিতা করুন, আমরা একসাথে এর মোকাবিলা করবো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এতো কিছু ঘটনার ঘনঘটা কিন্তু শুধুমাত্র Haizhu জেলাতেই। আমার বাড়ির সামনে পার্ল নদী। বাড়ি থেকে নদী অবধি হেঁটে যেতে দশ মিনিট লাগে, আর নদীর ওপর ব্রিজ পেরোতে আরও পাঁচ মিনিট। এই ১৫ মিনিট যদি আমি হাঁটতে পারতাম, বেরিয়ে যেতে পারতাম Haizhu জেলা থেকে। পৌঁছে যেতাম নদীর ওপারে Tianhe বা Yuexiu জেলায়। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট। কিন্তু ব্রিজ যে পেরবো, তার উপায় ছিল না। ব্রিজে ওঠার মুখে সশস্ত্র পুলিশ।

খবরে পড়লাম, কিছু মানুষ নদী সাঁতরে এই জেলা থেকে বেরোতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আর আমি? না, এতোটা সাধ্য আমার ছিল না। আর ছিল না বলেই, যত দিন এগিয়ে এসেছে, তত অশান্ত হয়ে উঠেছি। কোনদিন চি কে বলেছি, “যদি কোনোদিন এখান থেকে যেতে পারি, আমাকে এখানে আর ফিরতে বলিস না। আমি ওখানে ঠিক কিছু একটা করে নেবো, কিন্তু এখানে আর না।” মুহূর্ত পরে নিজেই অবাক হয়ে ভাবতাম, নিজের যে কর্মভূমিকে আমি একদিন এতো ভালোবেসে ছিলাম, আজ সেখান থেকে পালানোর জন্য আমি এতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছি? ভাবতে পেরেছিলাম যে পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ একদিন ঠিক করে দেবে প্রায় তিন বছর পর আমার দেশে ফিরতে পারা আর না পারা?

২৬ তারিখ ছিল শনিবার, আমার যাবার দিন।

২৪ তারিখ সকালে বসে টিকিট ক্যানসেল করলাম। এবারও যাওয়া হল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *