ঘুম ভেঙ্গেছিল ব্যাংকক পৌঁছে। প্লেনের চাকা আর এয়ারপোর্টের রানওয়ে একসাথে হবার ঝাঁকুনিতে।
ব্যাংকক দিয়ে কলকাতা গেছি আগে বেশ কয়েকবার। তাই Visa on Arrival এর অফিসটা খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হয়নি। ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে নামার পর Immigration কাউন্টারের দিকে হেঁটে যাবার সময় চোখে পড়ে Visa on Arrival লেখা বোর্ডটা। অফিসের সামনে একটা ডেস্কের ওপর অনেক ফর্ম রাখা। তার একটা ভরে ফেললাম – পাসপোর্ট নম্বর, ফেরার টিকিট, একটা ফটো – এই দিয়ে। ফাঁকা রেখে দিয়েছিলাম দুটো জিনিস – এখানে কোথায় থাকবো তার ঠিকানা আর আমার কাছে থাইল্যান্ডের কত টাকা আছে।
ফর্ম ফিলাপ করে, হাতে পাসপোর্ট আর ব্যাংকক থেকে কলকাতার টিকিট নিয়ে, আমি এগিয়ে গেলাম অফিসের দিকে। বেশ কিছু লোকের ভিড়, লাইন দিয়েছে সবাই। আমিও সেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নিয়ম মতো তিনটে লাইন থাকার কথা – একটা বড় গ্রুপে আসা লোকজনের জন্য, একটা ছোট গ্রুপের, মানে একা বা ফ্যামিলি, জন্য। আর একটা ফাস্ট ট্র্যাক লাইন – যাঁদের খুব তাড়া আছে, তাদের জন্য। এই লাইনে দাঁড়ালে ২০০০ ভাট ছাড়াও ৪০০ ভাট বেশী দিতে হবে। সেদিন ফাস্ট ট্র্যাক লাইন ছাড়া বাকি দুটো লাইনের অস্তিত্ব ছিল না।
লাইন শেষ হয়েছে একটা কাউন্টারের সামনে। এক সময় পৌঁছেও গেলাম সেখানে। কাউন্টারের জানালার ওদিকে বসা একজন অফিসার আমার কাগজপত্র একবার মাত্র উলটে পালটে দেখে OK বলে দিলেন। এবার টাকা জমা দেবার পালা। আমার কাছে ২০০০ ভাট আছে, বাকিটা ডলারে। কাউন্টারের জানালা ঘেঁসে দাঁড়ানো এক স্থানীয় ভদ্রলোক বললেন, “বাইরে থেকে করিয়ে নিয়ে আসুন। বাইরে money exchange এর কাউন্টার আছে।” পেছনে তাকিয়ে দেখি, লম্বা লাইন। তার মানে আমাকে আবার লাইনের পেছনে দাঁড়াতে হবে। আমি ইতস্তত করছি দেখে ভদ্রলোক বললেন, “সমস্যা নেই। আপনি টাকা এক্সচেঞ্জ করিয়ে এই লাইনের পাস দিয়ে কাউন্টারের সামনে চলে আসুন। আমি আছি, বলে দেবো।”
বাইরে এসে money exchange এর কাউন্টারে ২০ ডলারের একটা নোট বিক্রি করে পেলাম ৭০০ ভাট মতো। সেটা নিয়ে আবার কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লাইনের পেছন থেকে একটা শোরগোল উঠেছিলো ঠিকই, কিন্তু সেই ভদ্রলোক সামলে দিলেন। আমিও ২৪০০ ভাট আর আমার পাসপোর্ট জমা করে দিয়ে একটা স্লিপ পেলাম কাউন্টার থেকে। বলা হল, এই স্লিপটা নিয়ে এই কাউন্টারের পেছন দিকে চলে যান, সেখানে আর একটা কাউন্টার আছে। আমার পাসপোর্ট ওখান থেকেই দেওয়া হবে। তাই করলাম।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই আমার পাসপোর্ট এসে গেলো। খুলে দেখলাম, থাইল্যান্ডের ভিসা লেগে গেছে আমার পাসপোর্টে, ১৪ দিনের থাকার মেয়াদ সহ। এই কাউন্টারের পাশেই সারি সারি Immigration কাউন্টার। তার মধ্যে একটাতে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে কোন প্রশ্ন না করে, শুধু মুখের ছবি আর আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে, আমার পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে আমাকে ফেরত দিয়ে দিল। Immigration শেষ করে বাইরে এসে, ৪ নম্বর কনভেয়ার বেল্টের সামনে যখন দাঁড়ালাম, তখন দেখি আমার কালো রঙের American Tourister ঘুরে চলেছে নিজের মতো। তাকে তুলে নিয়ে হাতে ঝুলিয়ে এক্সিট লেখা গেট দিয়ে থাইল্যান্ডের মাটিতে এসে দাঁড়ালাম।
একবার ইচ্ছে হয়েছিল ঘুরে দেখি ব্যাংকক শহরটা। ঘড়িতে এখন সবে সন্ধ্যে সাড়ে ৭টা, স্থানীয় সময় হিসেবে। কলকাতার ফ্লাইট সেই রাত ৩টে ৪৫এ। কিন্তু মন চাইলেও শরীর দিচ্ছিল না। তাই আবার ঢুকে পড়লাম এয়ারপোর্ট এর ভেতরে। Indigo এর চেক ইন হবে W কাউন্টার থেকে। তার সামনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে আবার শুরু হল অপেক্ষা। ক্যানসেল করলাম ৩ তারিখের Thai Airways এর টিকিটটা।

আমি যেখানে বসেছিলাম, তার সামনেই একটা বড় ডিসপ্লে বোর্ড। সেই গুয়াংজু এয়ারপোর্টের মতো, কিন্তু কতো তফাৎ। ওখানে দেখে এসেছি প্রায় শূন্য এক ডিসপ্লে বোর্ডে অল্প কিছু গন্তব্যের নাম, আর এখানে উত্তর থেকে দক্ষিণ আমেরিকা হয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে এশিয়া – পৃথিবীর সব মহাদেশের কোন না কোন শহরের প্লেন হয় আসছে না হয় যাচ্ছে। ফাঁকা গুয়াংজু এয়ারপোর্টের চেয়ারগুলো যখন যাত্রীর অপেক্ষায়, ব্যাংকক এয়ারপোর্টে আমার পাশের চেয়ারগুলো ভরে উঠলো কত রকমের মানুষের ক্ষণিকের অপেক্ষায়। একবার এক বয়স্ক আফ্রিকান দম্পতি, তো তার কিছুক্ষণ পরেই এক ইউরোপিয়ান দম্পতি। তিনজন আমেরিকান মেয়ে এসে বসলো সেই চেয়ারগুলোতে। এক রাশিয়ান দম্পতি আর তাঁদের ছোট ছোট তিন ছেলেমেয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই মেয়েগুলো তাদের বসার জায়গা করে দিলো, নিজেরা দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলো কিছু দূরে। কিছু দূরে কয়েকজন জাপানী ছাত্রছাত্রী। আমার জীবনে এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। দেশ, জাতি, ধর্ম – মানুষের এই বিশাল হট্টমেলায় কোথায় তাদের দেখা মেলে?
এবার বাড়িতে জানানোর পালা।
একজন বলে, “চল সারপ্রাইজ দিই, কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই”।
অন্যটা বলে, “কয়েক মাস আগে নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে, সেটাকে আসতে বলবি না তোকে নিতে?”
প্রথম জন বলে, “ট্যাক্সি করে চলে যা। গাড়ি তো কালকেও চড়তে পারবি। কিন্তু এই সারপ্রাইজটা কি আর দিতে পারবি?”
দ্বিতীয় জন হাঁই হাঁই করে ওঠে, “ওরে সারপ্রাইজ দিতে যাস না। মনে আছে তো, আগের বার কি হয়েছিল? মা হটাত করে তোকে দেখে বুক ধরে বসে পড়েছিল। সেটাও প্রায় তিন বছর আগে। এখন সবার বয়স হয়েছে, তার ওপর তোকে এতদিন দেখেনি। কি দরকার?”
প্রথম জন বলে, “তাতে কি হয়েছে? চি আছে তো এবার বাড়িতে, ও ঠিক সামলে নেবে।”
কিন্তু শেষে দ্বিতীয় জনেরই জয় হল। বাড়িতে জানালাম। সবাই আসবে আমাকে নিতে। আমাদের নতুন গাড়ি নিয়ে। ততক্ষণ অবধি আরও একটা রাত জাগা।
এই পুরো যাত্রাপথে এতো গুলো আকস্মিক ধাক্কা খেয়েছি যে, যখন W গেটের সামনে লাগানো হল Indigo 6E078 এর বোর্ড, তলায় লেখা Kolkata, তখনও মনে সংশয় – এই শেষ ধাপটা পেরোতে পারবো তো? চীন থেকে আসছি বলে নতুন কোন কাগজ দেখতে চাইবে না তো? অন্য সময় হলে, এই সমস্ত প্রশ্ন মাথাতেও আসতো না। লাগেজ জমা করে, হাতে বোর্ডিং পাস নিয়ে, সিকুরিটি চেক শেষ করে যখন বোর্ডিং গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন ঘড়িতে রাত দুটো। যাত্রাপথের এই শেষ অংশে ঘুম পালিয়েছে কোথায়, জানা নেই।

ঘড়িতে যখন ভোর সাড়ে ৪টে, নীচে তাকিয়ে দেখলাম রাতের আলোয় ঘুমিয়ে থাকা আমার শহর। Indigoর প্লেন তখন কলকাতার মাটি ছোঁবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।

যখন এই লেখাটা শুরু করেছিলাম, তখন ভাবিনি এতগুলো পর্বে ভাঙতে হবে এটাকে। কিন্তু এখন শেষ পর্বে এসে মনে হচ্ছে, এই ভাঙ্গাটা দরকার ছিল। এতরকমের অভিজ্ঞতা সেই একটা মাসে অর্জন করেছিলাম, সব কিছু একটা পর্বের মধ্যে ঠেসে ভরা সম্ভব হয় না। এই লেখার শেষে যদি তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করো, “এতদিন পর ইন্ডিয়াতে ফিরে কেমন লাগছিলো? চীনের থেকে ভালো নিশ্চয়ই?”
প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ – অবশ্যই আমার খুব ভালো লেগেছিল। তিন বছর পরে নিজের সব থেকে কাছের মানুষগুলোকে দেখতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর শুধু ভালো খারাপে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই দুটো মাস আমাকে যেমন ভেঙ্গেছিল তিল তিল করে, ঠিক তেমনই আমাকে নিজেকে আরও ভালোভাবে বুঝতে, চিনতে শিখিয়েছিল। এতো রকমের পরস্পর বিরোধী অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, কোনটা ভালো, কোনটাই বা খারাপ – তা এক কথায় বলা সহজ নয়।
যেমন ধরো, গুয়াংজু থেকে হংকং হয়ে ব্যাংকক, সেখান থেকে কলকাতা – মানুষের মুখে মাস্ক কমতে কমতে কলকাতায় এসে যেন কোন মায়াবলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চীনের এয়ারপোর্টে দেখা কঠিন কঠোর নিয়মের সাথে মেলাতে পারি না কলকাতার immigration কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ধাক্কাধাক্কি, একে ওপরকে টপকে আগে যাওয়ার অদম্য প্রচেষ্টা। আমি আজও জানি না যে কেন আমাকে গুয়াংজুতে দু’মাস কোয়ার্যান্টিন পরিস্থিতিতে থাকতে হয়েছিল। ঠিক তেমনই আমি কলকাতার এয়ারপোর্টে ২% যাত্রীর জন্য কোভিড টেস্টের কোন জায়গা খুঁজে পাইনি। আমি এক দেশে সরকারের কঠোরতম নিয়ম দেখেছি, আবার একই সঙ্গে অন্য দেশে মহামারী সম্পর্কে মানুষের সবচেয়ে বড় উদাসীনতাও দেখেছি।
তোমরা বলবে, “এ তো ভারী অন্যায় তোমার। আরে যতই হোক, এটা তোমার দেশ, চারপাশে তাকিয়ে দেখো, এরা সবাই তোমার স্বদেশবাসী। ভালো হোক, মন্দ হোক, নিজের দেশের লোক। এতো যে সমালোচনা করছ, ভুলে গেলে কি ভাবে দেশে ফিরেছ? যাদের সাথে তুলনা টেনে আনছ, সেখানে শেষ একটা মাস কি পরিস্থিতির মধ্যে ছিলে, এর মধ্যে ভুলে গেলে?”
শেষ একটা মাস ভুলতে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এই শেষ এক মাসের সমস্ত কষ্ট যেমন সত্যি, কয়েকজন মানুষের ভালোবাসা, এতোটা স্বার্থহীনতা, এতোটা নিজের ভাবা – এগুলোও তো একই রকম ভাবে সত্যি।গত একটা মাসে অনেকগুলো দিন এমন এসেছে, যেদিন ভেবেছি একবার যদি দেশে ফিরতে পারি, তাহলে এখানে আর ফিরবো না। এটা যেমন সত্যি, তেমনই আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দেবার সময় ম্যাডামের চোখের জল, আমার ঘরের ডাস্টবিনের প্যাকেট স্যারের হাতে – এই ছবিগুলোও তো একই রকম ভাবে সত্যি। এতোগুলো টিকিটের পেছনে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যাবাটা যেমন সত্যি, তেমনি কলকাতা এয়ারপোর্টের ২A গেটের বাইরে আমার অপেক্ষায় রাত জেগে দাঁড়িয়ে থাকে আমার সব থেকে প্রিয় মানুষগুলোর হাসিমুখগুলোও তো সত্যি।
এই দু’টো মাস আমাকে সমাপতনে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির হাতে যার জাদুকাঠি। যদি আমি সেদিন হঠাৎ করে ইন্ডিয়ার কোভিড টেস্টের নতুন নিয়ম চেক না করতাম, এক্সিট পাস নিতে হয়তো যেতাম না। Haizhu জেলা থেকে এক ঘন্টা ট্র্যাভেল করেও আমার সবুজ QR কোড হলুদ হয়ে যায়নি। গুয়াংজু এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে কেউ আমার কোড চেক করেনি। পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত এয়ারপোর্টে একটাই মাত্র money exchange কাউন্টার খোলা পেয়েছিলাম। শীতকালের ঝলমলে আকাশ শুধু সেইদিন মেঘলা, যার জন্য হংকং থেকে আসা প্লেন লেট হয়েছিলো। এর মধ্যে কোনো একটা ঘটনাও যদি অন্যরকম হতো, তাহলে আমি আর ইন্ডিয়াতে ফিরতে পারতাম না। আমার তিন বছরের অপেক্ষার সাথে আরও কয়েকটা দিন, মাস বা বছর যোগ হতো।
তাই সেই এক মাসে কতোটা কষ্ট করেছি, কি হারিয়েছি, সে সব প্রশ্নের উত্তর কোথায় যেন এতোগুলো পাওয়ার মাঝে আবছা হয়ে যায়। আজ, তিন বছর পর, যখন আমি সেই দিনগুলোর কথা ভাবি, তখন আর সেই কষ্ট, দুঃখগুলোকে খুঁজে পাই না; উল্টে মনে পড়ে সেই দিনগুলোতে পাওয়া কত মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ এবং যত্নের কথাই।
আর সেই জন্যই হয়তো, ইন্ডিয়াতে এক মাস কাটিয়ে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমি আবার পাড়ি জমিয়েছিলাম চীনের উদ্দেশ্যে, ঠিক যেমনটা তাঁদের কথা দিয়ে এসেছিলাম।