যে সময়ের কথা লিখতে বসেছি সেটা ২০২২ এর শেষের দিক। কোভিড এসেছে, চলেও গেছে। যাবার আগে এই অতিমারি মানুষের জীবনে অনেক রকম ভাবে তার নিদর্শন রেখে গেছে। আমার জীবনে সেই ছাপ হল আমার জন্ম আর কর্মভূমির মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে, কিন্তু এই দু’দেশের মধ্যে পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হয়নি। কে ঠিক, কে ভুল, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখানে অবান্তর। শুধু নিজের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কয়েকটা অমূল্য সময় সারা জীবনের আফসোস হয়ে রয়ে গেছে।
তাই ২০২২ এর অক্টোবর মাসে প্রথম সপ্তাহে আমি ঠিক করলাম, এবার বাড়ি যাবো। শেষ বার বাড়ি গিয়েছিলাম ২০১৯ এর নভেম্বর মাসে, আর এখানে ফিরে এসেছিলাম ৬ই জানুয়ারী, ২০২০। পুজো শেষ হয়েছে সবে সবে, এই বছর নিয়ে পাঁচ বছর আমি কলকাতার বাইরে পুজোর সময়ে। কি ভাবে যাবো – জানি না। কি ভাবে ফিরবো – তাও অনিশ্চিত। কিন্তু একবার ফিরতে হবে। যদি ফিরতে পারি, চি কে নিয়ে ফিরবো। আর যদি ফেরা না হয়, তাহলে ওখানে কোন একটা চাকরির চেষ্টা করবো।
ফিরতে না পারার ধারণাটা মনে এসেছিল প্রধানত দুটো কারণে:
১। দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতের পরিস্থিতি। চীনে তখনও কড়াকড়ি চলছে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে। সরাসরি কোন প্লেন রুট না থাকায় আরও একটা বা দুটো দেশ ঘুরে আসতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই প্লেনের ভাড়া আকাশছোঁয়া।
২। সেই টিকিটও না হয় কাটলাম, কিন্তু তারপর রয়েছে দ্বিতীয় ধাপ – এখানে ঢোকার আগে ২৮ আর ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে কোভিড টেস্ট করাতে হবে। এর মধ্যে কোন একটা টেস্টে যদি আমি কোভিড পসিটিভ হই, তাহলে যাত্রার আশা সেখানেই শেষ।
৩। দ্বিতীয় ধাপ ঠিক ঠাক ভাবে পেরিয়ে গেলে এবং এই দেশে ঢুকে পড়তে পারলে, তারপর রয়েছে ১৪ দিনের বাধ্যাতমুলক কোয়ার্যান্টিন। না, নিজের বাড়িতে নয়, এখানে সরকারের ঠিক করে দেওয়া সেন্টারে। সেন্টার মানে বিলাসবহুল হোটেলের কামরা, আর তার খরচ নিজের।
হিসেব করে দেখলাম, টিকিট, টেস্ট, আর কোয়ার্যান্টিন নিয়ে ভারত থেকে চীনে ফেরার খরচ মাথা পিছু প্রায় দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি হবে। আমি যেখানে থাকি, সেই গুয়াংজু শহর আর কলকাতা শহর পৃথিবীর ম্যাপে একটা সরললেখা দিয়ে যোগ করা যায়। শেষ বার এখান থেকে Indigoর প্লেনে কলকাতা যেতে সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা মতো, ভাড়া পড়েছিল দশ হাজার টাকার একটু বেশী। তাই সেদিন রাতে শুয়ে একবার মনে হল, এতোগুলো টাকা বাড়ি যাবার জন্য খরচ করবো? এই টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিলে তো লাভ। কিন্তু কিছু সময় আসে মানুষের জীবনে, যখন লাভ ক্ষতির হিসেব গুলো সব গুলিয়ে যায়। আমি ততক্ষণে স্থির করে ফেলেছি – কালকেই কথা বলবো অফিসে।
“আমি বুঝতে পারছি, তোমার বাড়ি যাওয়াটা দরকার।” বললেন আমার স্যার।
“হ্যাঁ স্যার, এতদিন হয়ে গেছে, বাড়ি থেকেও অনেকবার বলছে একবার ঘুরে যা। পায়েলকেও এখানে নিয়ে আসতে হবে।” আমি বললাম।
“পায়েলের আসার কি হল?” জিজ্ঞাসা করলেন উনি।
এই প্রশ্নের কারণ এই কথোপকথনের কয়েকদিন আগেই আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম কি ভাবে চি কে এখানে নিয়ে আসা যায়। কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে হংকং, সেখান থেকে গুয়াংজু। অন্য সময় হলে কোন ব্যাপার ছিল না। সরাসরি ট্রেন, বাস, প্লেন, সব কিছুর অপশন থাকতো। কিন্তু এখন, হংকং থেকে মেনল্যান্ড চীনে ঢোকা সহজ নয়। রোজ লটারির মাধ্যমে ১০০০ জনের নাম ওঠে, তাঁরাই সেই দিন ঢুকতে পারে হংকং থেকে মেনল্যান্ডে। তাই ঠিক হয়েছিল হংকং থেকে চীনের অন্য একটা শহরে চি চলে যাবে। শহরটাও ঠিক হয়ে গেছিল – চেংডু। পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশের রাজধানী। সেখানে ও কোয়ার্যান্টিন করবে ১৪ দিন। আমরা, মানে আমি আর আমার স্যার, এখান থেকে চেংডু চলে যাবো, তারপর আমরা তিনজন একসাথে গুয়াংজু ফিরবো। হংকং এ আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা একজন ছাত্রীর সাথে কথাবার্তাও পাকা হয়ে গেছিল, সে চি কে সব রকম সাহায্য করবে।
“না স্যার, পায়েল একা আসতে ঠিক সাহস পাচ্ছে না। ওর বাড়ির লোকজনও খুব একটা রাজী নয় ওকে একলা ছেড়ে দিতে। আমাকে বলছে, তুমি এসে ওকে নিয়ে যাও।”
“হ্যাঁ সেটাও ঠিক। ও তো একা কোনোদিন এই ভাবে ট্রাভেল করেনি। তুমি তাহলে বাড়ি গিয়ে ওকে নিয়েই এসো। তা কোন ফ্লাইটে যাবে, কিছু ঠিক করেছ?”
“হ্যাঁ স্যার, Thai Airways এর একটা ফ্লাইট আছে। এখান থেকে ব্যাংকক, সেখান থেকে কলকাতা।”
“তাহলে ওটাই ভালো। ঠিক আছে, আমি একবার ইউনিভার্সিটিতে কথা বলে রাখি। তোমার এই ট্যুরটাকে যদি অফিসিয়াল করা যায়, তাহলে তোমার যাতায়াতের কিছুটা খরচ তুমি পেয়ে যাবে।”
“তাহলে তো খুব ভালো হয়।” বললাম যদিও, ব্যক্তিগত কারণে দেশে ফেরাটাকে ‘অফিসিয়াল ভিসিট’ করতে ঠিক মন চাইছিল না।

এর পর কেটে গেলো আরও কয়েকটা দিন। একদিন স্যার টেক্সট করলেন, “তুমি কতদিনের জন্য বাড়ি যেতে চাও?”
“দু মাস অন্তত”, বললাম আমি।
“আমি ইউনিভার্সিটিতে কথা বলেছি। এখানকার নিয়ম অনুযায়ী তুমি ব্যক্তিগত কারণে খুব বেশী হলে ২ সপ্তাহের জন্য ছুটি পেতে পারো। আর অফিসিয়াল ভিসিট হলে, এক মাস। তার বেশী ছুটি পাওয়া সম্ভব নয়।” স্যার বললেন।
আমি বলতে বাধ্য হলাম, “স্যার, তিন বছর হতে চলল আমি কোন ছুটি নিইনি। দু’ সপ্তাহে হবে না।”
“আমি বুঝতে পারছি। একটা কাজ করো, ভারতের কোন একটা ইউনিভার্সিটি থেকে একটা আমন্ত্রণ পত্র জোগাড় করার চেষ্টা করো। সেই আমন্ত্রণ পত্রে যেন পরিষ্কার ভাবে লেখা থাকে যে তাঁরা তোমাকে একটা বিশেষ কাজে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, আর এই কাজ শেষ হতে সময় লাগবে অন্তত দু’মাস।”
“হয়ে যাবে, স্যার”, আমি বললাম।
“আর তুমি এর মধ্যে দুটো জিনিস তৈরি করো – ভারতে গিয়ে তোমার প্রতিদিনের কাজের একটা প্রোগ্রাম আর তোমার যাতায়াতের একটা প্রোগ্রাম – মানে তুমি কবে যেতে চাইছ, কবে ফিরবে, কোন ফ্লাইটে, তার ভাড়া কতো – এই সব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগুলো করে আমাকে পাঠাও, তারপর আমি দেখছি কি করা যায়।”
প্রথম কাগজের জন্য ইমেইল করলাম অভিষেকদা কে। অভিষেকদা মানে, ডঃ অভিষেক মুখার্জি, Indian Statistical Institute এর একজন প্রফেসর। প্রতিবারের মতো এবারেও অভিষেকদা চিঠি পাঠিয়ে দিলো সেই রাতের মধ্যেই। যাতায়াতের প্রোগ্রাম বানাতেও বেশিক্ষণ লাগলো না। পরের দিন সমস্ত কাগজ দিয়ে দিলাম স্যারকে। তারপর শুরু হল অপেক্ষা।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আবেদনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, শেষ সপ্তাহে এসে তা শেষ হল। এর মাঝে অনেক কাগজ পালটাতে হয়েছে। নতুন করে কিছু চিঠি লিখতে হয়েছে। সেই সব বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন নেই। ইউনিভার্সিটি থেকে ইমেইল এলো, আমার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। ছুটি লিখলাম বটে, কিন্তু এটা তো ছুটি না, অফিসিয়াল কাজে দু’মাসের জন্য দেশে যাওয়া – অন্তত ইউনিভার্সিটির কাগজ তাই বলছে।
আর দেরী করলাম না টিকিট কাটার জন্য। সেই দিনই রাত্রে বসে টিকিট কাটলামঃ
২৬শে নভেম্বরঃ Thai Airways TG669 – গুয়াংজু থেকে ব্যাংকক, Thai Smile WE313 – ব্যাংকক থেকে কলকাতার
ভাড়া পড়ল ২৯৭৮ RMB, ভারতীয় মুদ্রায় ৩০,০০০ টাকার মতো। তারিখটা ২৫শে অক্টোবর, ২০২২।

বাড়িতে জানানোর পর সবার খুব আনন্দ। আমি বাড়ি আসছি অবশেষে। সেই রাত্রে আনন্দের চোটে ভালো করে ঘুম পর্যন্ত হল না। কিন্তু তখন যদি জানতাম, এর পর আর আনন্দের আতিশয্যে নয়, ঘুম পালাবে দুশ্চিন্তায় – তাহলে সেই রাত্রে একটু ভালো করে ঘুমিয়ে নিতাম।