বিগত এতোগুলো বছর ধরে পড়াশুনোর সাথে সম্পর্ক থাকার সুবাদে ভারত তথা পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটির South ক্যাম্পাস এক নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এই ক্যাম্পাসে ঢুকলে সবার আগে যেটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটা হল অতীত আর ভবিষ্যতের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। সুবিশাল প্রাচীন অট্টালিকা হোক, কিংবা রাস্তার দু’ধারে বহুবর্ষজীবী মহীরুহ, পুরনো যা কিছু তাকে সযত্নে আগলে রেখে নতুন কিছু করার চেষ্টা।
তাই আজ সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটির South ক্যাম্পাস গুয়াংজুর দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে একটা। এই পর্বে থাকলো ইতিহাসের গন্ধ মাখা এমন সাতটা জিনিসের কথা যা না দেখলে এই ক্যাম্পাস ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ল্যান্ডমার্ক ১ – সান ইয়াট-সেনের বাড়ি
৪৯২ Southwest District
আগের পর্বে লিখেছিলাম Yixian Road, South গেট থেকে সোজা এসে একটা দোতলা বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়ে সেই বাড়িটার দু’পাশ দিয়ে চলে গেছে। এটা সান ইয়াট-সেন এর বাড়ি, চাইনীজ ভাষায় যার নাম Wai Shi Tang।
ছোটবেলায় রাশিয়ান সাহিত্য পড়তাম বাংলা অনুবাদে। সেখানে মাঝে মাঝে গম্বুজওলা বাড়ির ছবি থাকত। লাল ইটের বাড়ি, বাম দিক থেকে ডান দিকে অনেকগুলো জানালা। সবুজ রঙের ছাদ বাড়িটার ওপরে একটা ত্রিভুজের সৃষ্টি করেছে। সেই ছাদের ওপরে সমান দূরত্বে তিনটে গম্বুজ। এটা বাড়িটার পেছনের দিক। সামনের দিকে স্থাপত্য একবারে অন্যরকম। দোতলা বাড়িটার দুদিকে দুটো টাওয়ার সোজা ওপরের দিকে উঠেছে। টাওয়ার দুটোও লাল রঙের, গায়ে সবুজ রঙের টাইলস বসানো নীচ থেকে ওপরে। দুই টাওয়ারের মাঝের অংশে বাড়িতে ঢোকার প্রধান প্রবেশপথ, ৮ ধাপ সিঁড়ি উঠে বারান্দা, আর তারপরে মস্ত বড় হলঘর।

সিঁড়িতে ওঠার মুখে পাথরের ফলকে লেখা সান ইয়াট-সেন এর সেই অমর উক্তি
学生要立志做大事,不可做大官
যা বাংলা করলে দাঁড়ায় –
শিক্ষার্থীদের বড় কাজ করার আকাঙ্ক্ষা করা উচিত, বড় কর্মকর্তা হওয়ার জন্য নয়
ল্যান্ডমার্ক ২ – মার্টিন হল
৩৩৪ Northeast District
সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটির প্রথম স্থায়ী বাড়ি। লাল ইট, সবুজ টাইলস আর কংক্রিট দিয়ে এই বাড়িটা বানানো শেষ হয় ১৯০৬ সালে। প্রথমে এটা ছিল লিংনান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অফিস। আমেরিকার সিনসিনাটি শহরের একজন শিল্পপতি, হেনরি মার্টিনের সম্মানে, যিনি একজন বিদেশী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সব থেকে বেশী টাকা অনুদান দিয়েছিলেন, এই বাড়ির নাম হয় মার্টিন হল, যা আজও ব্যবহৃত হয়।

১৯১২ সালে ৫ই মে সান ইয়াট-সেন যখন লিংনান একাডেমী পরিদর্শন করতে আসেন, তখন এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে “কোন শিক্ষা গড়ে তোলা যায় না” বলে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই দিনে ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের সাথে তোলা সান ইয়াট-সেনের গ্রুপ ছবি লাগানো রয়েছে এই বাড়ির গায়ে একটা সাদা মার্বেল ফলকে।
আজ এই বাড়িতে রয়েছে ইউনিভার্সিটির Sociology এবং Anthropology বিভাগ।
ল্যান্ডমার্ক ৩ – ব্ল্যাকস্টোন হাউস
৩০৬ Northeast District
প্রথমে এই বাড়িটা ছিল ইউনিভার্সিটির স্টাফদের বাসস্থান বা ডরমিটরি। পরে লিংনান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চাইনীজ প্রেসিডেন্ট ঝং রংগুয়াং এর বাসস্থানে পরিণত হয়। এই ঝং রংগুয়াং ছিলেন সান ইয়াট-সেনের বিপ্লবের সহযোদ্ধা। প্রচুর বিপ্লবী এক সময় এই ব্ল্যাকস্টোন হাউসে আশ্রয় পেয়েছিল।

এই বাড়ি তৈরির সময় প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছিলেন আমেরিকার শিকাগো শহরের মিসেস ইসাবে ব্রোস্টোন নামে একজন মহিলা। ১৯১৪ সালে তাই এই বাড়ির নামকরণ হয় ব্ল্যাকস্টোন হাউস।
ল্যান্ডমার্ক ৪ – বেল প্যাভিলিয়ন
ইউনিভার্সিটির ঠিক মাঝখানে
সান ইয়াট-সেন যখন চীনের রাজতন্ত্রের অবসানের জন্য বিপ্লব করছেন, সেই সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র তাঁর বিপ্লবে যোগ দেন। এদের মধ্যে তিন জনের নাম জড়িয়ে আছে এই জায়গাটার সাথে। প্রথম জনের নাম শি জিয়ানরু, যিনি ১৮৯৯ সালে এই ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হবার পরেই বিপ্লবে যোগ দেন, এবং ১৯০০ সালে গুয়াংজু শহরে গ্রেপ্তার হন।
দ্বিতীয় জন, আউ লিঝৌ, ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং তৃতীয় জন, জু ইয়াওঝাং, ছিলেন এখানকার ছাত্র। ১৯২৫ সালের ২৩শে জুন ঘটে ইতিহাস-কুখ্যাত শাকি গণহত্যা (Shakee Massacre)।
১৯২৫ সালের মে মাসে চীন দেশে শুরু হয় বিদেশী ব্রিটিশ এবং ফরাসি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সাংহাই থেকে শুরু হয়ে তার আঁচ এসে পড়ে বিদেশী বানিজ্যের ঘাঁটি হংকং এবং গুয়াংজু শহরে। ২৩ শে জুন গুয়াংজুতে ১০০,০০০ এরও বেশি লোক একত্রিত হয়ে বিদেশী শক্তির বহিষ্কারের দাবিতে শাজি (ক্যান্টনিজ ভাষায়, শাকি) নামক এক জায়গায় যাবার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এই শাকি আজকের গুয়াংজু শহরের Liwan জেলায় অবস্থিত একটা জায়গা। শাকির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পার্ল নদীর একটা ছোট শাখা। আর নদীর ওপারে শামিয়ান দ্বীপ, যেখানে বিদেশী দূতাবাস, অফিস – সমস্ত কিছু। শাকি আর শামিয়ান মাঝে একটা সেতু দিয়ে যুক্ত। রাত ৩টের সময় বিক্ষোভ যখন এই সেতুর কাছাকাছি পৌঁছয়, তখন সংঘর্ষ শুরু হয়। ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, পার্ল নদীতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ থেকেও গুলি চালানো হয়। সেদিন প্রায় ৫০ জন মানুষ মারা যান এবং ১৭০ জনেরও বেশী মানুষ গুরুতর আহত হন। এই মৃত মানুষদের তালিকায় নাম ছিল আউ লিঝৌ এবং জু ইয়াওঝাং – শিক্ষক এবং ছাত্র দুজনেরই।

১৯২৮ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের খরচে তৈরি করেন এই বেল প্যাভিলিয়ন তাদের এই তিন সহপাঠী এবং সহকর্মীর স্মৃতির উদ্দ্যেশে। লাল স্তম্ভের বসানো নীল চুড়োর নীচে থাকা এই ঘণ্টা আজ এতো বছর পরেও সান ইয়াট-সেনের ব্রোঞ্জের মূর্তির দিকে তাকিয়ে।
ল্যান্ডমার্ক ৫ – গ্র্যান্ড হল
৩৩৩ Northeast District
উদ্বোধনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত গ্র্যান্ড হল ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক অফিস। ১৯১৫ সালে কাজ শুরু হয়ে এই বিল্ডিঙের গঠন শেষ হয় পরের বছর জুন মাসে। লিংনান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল মিঃ গ্রান নামে এক ভদ্রলোকের। তাঁর নামানুসারে এই বাড়িটার নাম হয় গ্র্যান্ড হল।

আজ প্রশাসনিক ভবন হিসেবে কাজ করা ছাড়াও এই বাড়িটা ইউনিভার্সিটির প্রধান দ্রষ্টব্যগুলোর মধ্যে একটা। এমনকি মাঝে মাঝে সিনেমার শুটিং এর জন্য ব্যবহৃত হয় এই বাড়ি। যেমন ২০১০ সালের একটা সিনেমা Bruce Lee My Brother এর কয়েকটা অংশ শুটিং হয়েছিল এই ক্যাম্পাসে।
ল্যান্ডমার্ক ৬ – ইয়ি আগলি জিনশি তোরণদ্বার
ইউনিভার্সিটির সবথেকে পুরনো স্থাপত্য।
দশম শতাব্দীর শেষের দিকে, উত্তর Song রাজবংশের প্রথম দিক থেকে চীনের সরকারী আমলাতন্ত্র পরিচালিত হতো সিভিল পরীক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত পণ্ডিতদের দ্বারা। এই পরীক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি ছিল ‘জিনশি’, ইংরেজিতে যার মানে হয় ‘Presented Scholar’। মিং রাজবংশের সময় ১৬৩৫ সালে দক্ষিণ চীনের সাতজন জিনশির নামে তৈরি করা হয় শহরের মধ্যে চারটে তোরণদ্বার। আর ‘আগলি’ শব্দের ব্যবহার কোন বছরে এই তোরণদ্বার তৈরি সেটা বোঝাতে। চীনে বছরের নামকরণ করা হয় ১২ টা পশুর নামে। এর মধ্যে Year of the Ox কে বলা হয় Ugly Year। ১৬৩৫ সাল ছিল Year of the Ox।

এর মধ্যে তিনটে তোরণদ্বার সময়ের সাথে, শহরের বৃদ্ধির সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যায়। একটি তোরণদ্বার রক্ষণা বেক্ষণ করার দায়িত্ব পায় লিংনান বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৭ সালে শহরের মধ্যে থেকে এই তোরণদ্বার সরিয়ে নিয়ে আসা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে। কারণ ছিল একটাই, জিনশিদের জন্য বানানো কোন স্মৃতি সৌধের সঠিক জায়গা হতে পারে একমাত্র কোন বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ১৯৫২ সালে লিংনান বিশ্ববিদ্যালয় তার সমস্ত কিছু সম্পদ নিয়ে সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মিশে যায়, আর বেলেপাথরের তৈরি এই তোরণদ্বার হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক নিদর্শন।
ল্যান্ডমার্ক ৭ – উত্তর গেটের তোরণদ্বার
সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটি কে বলা হয় দক্ষিণ চীনের আকাশের এক স্তম্ভ (one pillar of the southern sky)। আর সেই স্তম্ভের সমস্ত খ্যাতি, গরিমা যেন ভরে দেওয়া হয়েছে North গেটের এই বিশাল তোরণদ্বারের প্রতিটা সত্ত্বায়। পার্ল নদীর পারে অবস্থিত এই তোরণদ্বার সত্যি দর্শনীয়, আকর্ষণীয়। গায়ে লাল অক্ষরে লেখা চাইনীজ শব্দগুলোর মানে করলে দাঁড়ায় – “National Sun Yat-sen University“।
