২০১৮ সালে আমার চীন দেশে পদার্পণ – পি এইচ ডি শেষ করার পরে পোস্ট ডক্টরেট করার জন্য। তারপর কেটে গেছে পাঁচটা বছর। এই পাঁচ বছরে আমার কর্মক্ষেত্রটাকে আরও ভালো করে চিনেছি, আরও বেশী করে ভালবেসেছি। জেনেছি তার একশো বছরেরও বেশী পুরনো ইতিহাস, উঁকি মেরেছি তার আজকের কাঠামোর ভেতরেও। যত দিন গেছে, তত আরও বেশী করে অবাক হয়েছি এই বিশাল কর্মকাণ্ড দেখে।
এই লেখার পাঁচটা পর্বে থাকলো দক্ষিণ চীনে অবস্থিত দেশের এবং পৃথিবীর অন্যতম সেরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত আর বর্তমানের গল্প। আজ প্রথম পর্বেঃ
- শুরুর কথা – কি ভাবে এলাম এখানে
- কে ছিলেন সান ইয়াট-সেন?
- কি ভাবে শুরু হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়?
কিভাবে এলাম এখানে?
“তুমি নিজে কম্যুনিস্ট ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী, যাচ্ছও কম্যুনিস্ট দেশে”। আমি দেশ ছাড়ার আগে আমার মামাতো ভাই আমার জন্য একটা ভিডিও বানিয়েছিল, তাতে অনেক কথার মধ্যে এই কথাটাও ছিল। ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি ভারতবর্ষের যে রাজ্যে, সেখানে কম্যুনিস্ট সরকার। বাড়িতে দাদু, বাবা কে দেখেছি ভোটের সময় নিয়ম করে কাস্তে হাতুড়ি তারার পাশের বোতাম টিপতে। নিজের অজান্তেই কবে যে আমি সেই মতাদর্শে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, জানি না। নতুন দেশে যাচ্ছি, কবে ফিরবো বা আদৌ ফিরবো কিনা জানা নেই, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা আমার মনে আসেনি।
Indian Statistical Institute থেকে ২০১৬ সালে পি এইচ ডি থিসিস জমা দেবার পর postdoc ফেলোশিপ খুঁজতে খুঁজতে একদিন মনে পড়ল চীনের কথা। চার বছর আগে আমি গিয়েছিলাম একটা কনফারেন্সে চীন দেশে। কনফারেন্সে যাবার আগে দক্ষিণ চীনের এক শহরে একজন প্রোফেসরের ল্যাবে কয়েকদিন কাটিয়েছিলাম। এই প্রোফেসরের নাম ডঃ ইয়েলিন হুয়াং। আমাদের দুজনের রিসার্চ এর বিষয়বস্তু একই ছিল। ২০১৬ এর এপ্রিল মাসের শেষে একদিন তাঁকে ইমেইল করলাম। ইতিবাচক উত্তর এলো এই প্রোফেসরের কাছ থেকে পরের দিনেই।
এর পরের সময়টা কেটে গেলো খুব তাড়াতাড়ি। ২০১৬ সালে অগাস্ট মাসে থিসিস জমা দিয়ে ২০১৭ এর অক্টোবর মাসে পি এইচ ডির সার্টিফিকেট হাতে পেলাম। বাকি সমস্ত কাগজ তৈরি ছিল, সব একসাথে পাঠিয়ে দিলাম ডঃ হুয়াং কে। খবর এলো সেই বছরের কালীপূজোর দিন সকালে, আমি তখন মুম্বাইতে একটা কোম্পানিতে চাকুরীরত। চীনে আমার অ্যাপ্লিকেশান সফল হয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন জয়েন করি। মুম্বাইয়ের কাজে ইস্তফা দিয়ে কলকাতা ফিরলাম। ২০১৮ এর ২১ শে মার্চ পাড়ি জমালাম চীন দেশের উদ্দ্যেশে। আমার কর্মক্ষেত্র হতে চলেছে দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশের রাজধানী গুয়াংজুতে অবস্থিত এক শতাব্দী প্রাচীন ইউনিভার্সিটি, যার নাম Sun Yat-sen University।
সান ইয়াট-সেন (Sun Yat-sen) – আধুনিক চীনের পথপ্রদর্শক
দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশে এক ছোটো শহর জিয়াংশান, এখন যার নাম ঝংসান। সেখানে ১২ই নভেম্বর ১৮৬৬ সালে এক গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম হয় সান ইয়াট-সেন এর। তাঁর আসল নাম সান ওয়েন, আবার তিনি পরিচিত সান ঝংশান নামেও। মাত্র ১৩ বছর বয়সে দাদার সাথে হনলুলু যাত্রা, যেখানে আগামী চার বছরে সান ইয়াট-সেন পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ধ্যানধারণার সংস্পর্শে আসেন। কিন্তু তাঁর দাদা, যিনি ওখানে শ্রমিকের কাজ করতেন, ভাইয়ের এই পাল্টে যাওয়া চিন্তাভাবনার ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৮৮৩ সালে সান ইয়াট-সেন ফিরে আসেন হংকং, সেখানে সেই বছরের শেষেই তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।
এর পর শুরু হয় তাঁর নিজের দেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। অনেক বার জেল খেটেছেন, বন্দী হয়ে জাপানে কাটিয়েছেন বহু বছর। কিন্তু সেখান থেকে চালিয়ে গেছেন তাঁর কার্যকলাপ। ধীরে ধীরে দেশের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পরে তৎকালীন ছিং (Qing) সামাজ্র্যের বিরুদ্ধে। ১৯১১ সালে দেশের সেনা, ব্যাঙ্ক আধিকারিক এবং শহরের বুদ্ধিজীবীরা একটা জোট গঠন করে, এবং মধ্য চীনের নানজিং শহরে ২৯শে ডিসেম্বর এক মিটিঙে সিদ্ধান্ত নেন গণতান্ত্রিক চীন প্রতিষ্ঠার। ১৯১২ সালের প্রথম দিনে শেষ Qing সম্রাট আত্মসমর্পণ করেন এবং এর সাথেই শেষ হয় বিগত ৩০০০ বছরের সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা। জন্ম নেয় Republic of China।
সান ইয়াট-সেনকে ফিরিয়ে আনা হয় জাপান থেকে। নতুন জন্ম নেওয়া এই গণতান্ত্রিক দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সান ইয়াট-সেন। ১৯১২ থেকে তাঁর জীবনের বাকি ১৩টা বছর কেটেছে এই নতুন গণতান্ত্রিক দেশে ঐক্য আর স্থিতিশীলতা আনতে, গৃহযুদ্ধ এবং দেশ জুড়ে কৃষক আন্দোলন সামাল দিতে। কিন্তু কোনোদিনই সক্ষম হতে পারেননি সম্পূর্ণভাবে। তাঁর জীবদ্দশায় ১৯২১ সালে জুলাই মাসে সৃষ্টি হয় চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি, যারা ১৯৪৯ সালে ন্যাশানালিস্ট পার্টিকে যুদ্ধে হারিয়ে প্রতিষ্ঠা করে আজকের চীন দেশ, যার নাম People’s Republic of China।

সান ইয়াট-সেন তাঁর সমসাময়িক সমস্ত নেতার থেকে আলাদা ছিলেন তাঁর বহির্বিশ্বের সম্পর্কে সম্যক ধারণায়, যা তাঁকে সাহায্য করেছিল আধুনিক চীনের পথপ্রদর্শক হতে। তবে তাঁর সব থেকে বড় অবদান, যা আজকের কম্যুনিস্ট পার্টিও স্বীকার করে, তা হল তাঁর বিপ্লবী মনোভাব, যেখান থেকে আজকের চীনের জন্ম। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে, বেইজিং শহরে সান ইয়াট-সেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিনটা ১২ই মার্চ, ১৯২৫ সাল।
সান ইয়াট-সেন তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে স্থাপন করেন এই ইউনিভার্সিটি, ১৯২৪ সালে। তাঁর অপর নাম, সান ঝংশান, অনুসারে ইউনিভার্সিটির নাম হয় ঝংশান ইউনিভার্সিটি।
ইউনিভার্সিটির শুরুর কথা
সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল তার সৃষ্টিকর্তার রাজনৈতিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে। সময়ের সাথে সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে – অনেক বিভাজন যেমন হয়েছে, তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠান এর সাথে জড়িতও হয়েছে। এই অংশে একটু ফিরে দেখা যাক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম দিনগুলোর দিকে।
১৯২৪ সালে, সান ইয়াট-সেন, ক্যান্টন বা আজকের গুয়াংজু শহরে প্রতিষ্ঠা করেন National Kwangtung University। এর ঠিক এক বছরের মাথায় তাঁর মৃত্যুর পরে, চীনের কম্যুনিস্ট এবং ন্যাশানালিস্ট পার্টি মিলে প্রতিষ্ঠা করে জাতীয়তাবাদী সরকার, বা Nationalist government। এই সরকার সান ইয়াট-সেনের স্মরণে ১৯২৬ সালের ১৭ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ন্যাশনাল সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটি বা জাতীয় সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয়।
এই সময় চারটি জাতীয় সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয় ছিলঃ
- ক্যান্টনের প্রথম ন্যাশনাল সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয় (আজকের সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয়)
- উহানের দ্বিতীয় ন্যাশনাল সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান উহান বিশ্ববিদ্যালয়)
- হাংঝুতে তৃতীয় ন্যাশনাল সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়), এবং
- নানকিংয়ে চতুর্থ ন্যাশনাল সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান নানজিং বিশ্ববিদ্যালয়)।
১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর, ন্যাশনাল সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয় নাম থেকে “ন্যাশনাল” শব্দটি বাদ দেয়। নতুন নাম হয় – সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয়।

সময়ের সাথে অনেক প্রতিষ্ঠান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল
- Pok Tsai Medical School এবং
- লিংনান বিশ্ববিদ্যালয় (Lingnan University)
প্রথমটি স্থাপিত হয় ১৮৬৬ সালে, চীনের প্রথম স্কুল যেখানে পড়ান হতো পশ্চিমের চিকিৎসা পদ্ধতি বা western medicine। Pok Tsai Medical School সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাকাপাকি ভাবে ঢুকে পড়ে ২০০১ সালে, যার বর্তমান নাম সান ইয়াট-সেন কলেজ অফ মেডিকেল সায়েন্স।
দ্বিতীয়টি ছিল একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যা স্থাপন করেছিলেন Andrew Harper নামে একজন আমেরিকান এবং কয়েকজন আমেরিকান খ্রিস্টান মিশনারি। ১৯৫৩ সালে লিংনান বিশ্ববিদ্যালয় সান ইয়াট-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আসার পর ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় লিংনান কলেজ, যা আজকের দিনে অর্থনীতি এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্টে দেশের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
