‘একদিনের প্যারিস’ এর সপ্তম পর্বে শুধু খাওয়া দাওয়ার গল্প – ফ্রান্সের বিখ্যাত Macron আর শতাব্দী প্রাচীন এক রেস্তোরাঁয় ডিনারের অভিজ্ঞতা।
যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, সেটা দিয়ে আর ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। তাই এবার নদীর উলটো পাড়ের রাস্তাটা ধরে ফেরা শুরু করলাম। এই রাস্তাটার নাম কখনও Quai Branly, কখনও বা Quai d’Orsay, আবার কখনও Quai Anatoly France। ইংরাজিতে Quai শব্দের মানে ডক, নদীর পারে বলে সব রাস্তার নামের আগে বোধ হয় ডক জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই রাস্তার ডান দিকে পরল বেশ কয়েকটা মিউজিয়াম, হোটেল, চার্চ। আরও বেশ কিছুদূর হাঁটার পর দেখতে পেলাম Orsay মিউজিয়াম, যার উল্টো দিকে সেই Tuileries বাগান, বুঝলাম অর্ধেক রাস্তা আসা গেছে। দ্রুত সন্ধ্যে নামছে, আকাশের নীল কালো মেঘে এবার দেখলাম লালচে হলুদ রঙ লেগেছে। নদীর পাশের রাস্তায় পাঁচিলের গায়ে কিছুদূর অন্তর অনেক সবুজ বাক্স দেখেছিলাম যাবার সময়, দেখতে অনেকটা আমাদের ছোটবেলায় অনেক বাড়িতে যে রকম ডালা দেওয়া ডেস্ক থাকতো বা অনেক ব্যবসায়ীর গদিতে দেখা যেত, যার ওপর রেখে লেখালেখি করা হত আর ডালাটা খুলে তার ভেতর বই খাতা, পেন পেন্সিল রাখা হত, অনেকটা সেরকম। এগুলো শুধু আকারে বড়। এখন ফেরার সময় দেখি সেগুলো বইয়ের দোকান, বেশ কিছু খুলেছে। তার মধ্যে একটার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, সেটা পুরনো বই আর রেকর্ডে ঠাসা। নদীর দু’পারেই এই রকম বইয়ের দোকান আছে, বলা হয় সেইন নদী নাকি পৃথিবীর সব থেকে পুরনো বইয়ের বাজারকে দু’ভাগে ভেঙ্গে মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে।

ফ্রান্সের বিখ্যাত Macron
এই সব দেখতে দেখতে যখন সূর্যদেব আজকের মত কাজ শেষ করে পাটে বসলেন, তখন মোবাইলের ম্যাপে দেখলাম আমি হাঁটছি Quai Malaquais ধরে, যেখান থেকে এবার আমাকে ডান দিকের Rue Bonaparte বলে রাস্তাটা ধরতে হবে আমার পরের গন্তব্যে যেতে। কিছুদূর এগুতেই বাঁদিকে পড়ল দোকানটা যার নাম Ladurée। আইফেল টাওয়ার থেকে এই অবধি হেঁটে আসতে সময় লাগলো প্রায় ৪০ মিনিট। এই দেড় কিলোমিটার দূরত্ব আরও কম সময়ে অতিক্রম করা যেতো, কিন্তু পা আর চলছে না। এই দোকানে আসার উদ্দ্যেশ্য macron টেস্ট করা। macron হল একটা বিস্কুট স্যান্ডউইচ যেটা তৈরি হয় ডিমের সাদা অংশ, চিনি আর বাদামের ময়দা দিয়ে। ভেতরের পুরটা থাকে কখনও ক্রিম, কখনও জ্যাম। রঙ্গিন এই খাবার প্যারিসের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্যারিস শহরে Ladurée র অনেক ব্রাঞ্চ আছে, এটা সবথেকে পুরনো। দোকানটা খুব বড় নয়, কাউন্টারে হরেক রকম macron থরে থরে সাজানো। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, খুব বেশী হলে তিন দিনের বেশী এই জিনিষ রাখা যাবে না, খেয়ে ফেলতে হবে। তাই বাড়ির জন্য নিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা পরিত্যাগ করতে হল। নিজের জন্যই দু-তিন রকমের macron কিনে হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম। হোটেলে গিয়েই টেস্ট করবো।

এবার ডিনারের পালা
আইফেল টাওয়ার থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার পথ হেঁটে যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন শরীরে আর কিছু নেই। ঘড়িতে বাজছে সন্ধ্যে সাড়ে ৭ টা। হাত মুখ ধুয়ে পর পর দু’কাপ কফি খেয়ে একটু চাঙ্গা হলাম। তারপর মনে পরল আরও একটা জায়গায় যাবার আছে আজকে, রাত ৯টায় এপয়েন্টমেন্ট। কি করব ভাবতে ভাবতে বেরিয়েই পরলাম। যেটুকু গরম হয়েছিলাম, বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া আর কনকনে শীত সবটুকু শুষে নিল। ম্যাপ দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। হোটেল থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা ধরে নদীর দিকে যাওয়া, সেটা দিয়ে একটু গেলেই একটা চার মাথার মোড়, সেখান থেকে বাঁদিকে আরও মিনিট দশেক মত হেঁটে গুনে গুনে পাঁচ নম্বর ডান দিকের রাস্তাটা ধরে ঢুকলাম। একটু এগুতেই ডান হাতে পরল Le Procope, সেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহ্যবাহি রেস্তোরাঁ। হোটেল থেকে দূরত্ব যদিও মাত্র ৫০০ মিটার, কিন্তু এই দশ মিনিট হেঁটেই পা দুটো আর শরীর যেন ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। সারাদিনের ক্লান্তি শোধ তোলা শুরু করেছে।
রেস্তোরাঁয় ঢুকে সামনেই রিসেপশান, সেখানে গিয়ে নিজের নাম বলতেই তারা কনফার্ম করল যে আমার নামে বুকিং আছে। এক মহিলা এগিয়ে এসে আমার জ্যাকেটটা চাইলেন। সিনেমায় দেখেছি এরকম অনেকবার, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই প্রথম, তাই একটু কিন্তু কিন্তু করে নাই বললাম। তারা নিয়ে গিয়ে বসাল ভেতরে একটা টেবিলে। আমার পাশের টেবিলে এক আমেরিকান পরিবার – বাবা, মা, মেয়ে। ভালো করে গুছিয়ে বসে চারপাশে তাকালাম, সব দিকে প্রাচীনত্বকে ধরে রাখার আধুনিক চেষ্টার ছাপ স্পষ্ট। কোন কোন বিখ্যাত লোক এখানে এসেছেন, তারা কোথায় বসেছেন, কি শিল্প সৃষ্টি হয়েছে এই রেস্তোরাঁর টেবিল গুলোতে, তার বিশদ বিবরণ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও তিন চারজন পুরুষ-মহিলা – সবারই পোশাক পরিচ্ছদে, আচার বিচারে আভিজাত্যের ছাপ। তারা খাচ্ছে, গল্প করছে, এই সব দেখতে দেখতে একজন ম্যানেজার গোছের লোক এগিয়ে এলেন আমার টেবিলের দিকে, নিশ্চয়ই অর্ডার নিতে।
দুটো মেনু কার্ড – প্রথমটা পানীয়ের, আর পরেরটা খাবারের। আমি প্রথম টা থেকে অর্ডার করলাম Louis Roederer শ্যাম্পেন, দু’শতকেরও বেশী পুরনো এই কোম্পানির নাম দেশে থাকতে শুনেছিলাম বললে বাড়িয়ে বলা হবে, কিন্তু এখানে আসার আগে নিশ্চয়ই পড়েছিলাম। সেই শ্যাম্পেন নিলাম ১০ মিলি মতো, ফ্লেভার রোজ গোল্ড। আর মেন ডিশে অর্ডার করলাম শুরুতে Scottish smoked salmon, ঐতিহাসিক মেনু Braised beef cheek with Parmesan macaroni আর শেষে Pear crumble আইসক্রিম। খাবার ডেলিভারির মেয়ে আলাদা, যিনি অর্ডার নিয়েছিলেন তিনি আবার এলেন শেষে, বিল নিয়ে। সব মিলিয়ে খরচা হয়ে গেলো প্রায় ৭৫ ইউরো মতো।


বিল মিটিয়ে বাইরে এসে ভাবলাম, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচা করে কেমন খেলাম? Salmon মাছের প্রিপারেশনটা বাদ দিলে বাকি সব ক’টাই খুব ভালো ছিল। তারপরই মনে হল, নতুন দেশে নতুন খাবার পুরনো এক রেস্তোরাঁয় বসে – এই অভিজ্ঞতাটা শুধুমাত্র টাকা দিয়ে হয়তো বিচার করাটা ঠিক হচ্ছে না। আবার কবে আসবো বা আদৌ আসবো কিনা, জানি না। ভবিষ্যৎ যেখানে অনিশ্চিত, তখন বর্তমানের দাম সত্যি কতটা থাকে? এই সব ভাবতে ভাবতে আর ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরটাকে যখন টেনে এনে হোটেলে ঢোকালাম, তখন প্রায় ১০ টা বাজে। ঘরে ফিরে সোজা বিছানায়।